মাল্টা অন্যতম জনপ্রিয় ফল। সারাবিশ্বে উৎপাদিত সাইট্রাস ফসলের দুই তৃতীয়াংশ হলো মাল্টা। ভিয়েতনাম, উত্তর পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ চীন মাল্টার আদি উৎপত্তি স্থল। বাজারে বিদেশ থেকে আমদানি করা সবুজ ও কমলা রঙের মাল্টা বিক্রি হয়।
তবে বাংলাদেশেই এখন মাল্টার চাষ হচ্ছে। কমলার তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশি হওয়ায়, পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য এলাকায় সহজেই চাষ করা যায়। গ্রীষ্ম ও শীতকাল কম বৃষ্টি হলে মাল্টা চাষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। বায়ুম-লের আদ্রতা ও বেশি বৃষ্টিপাত মাল্টা ফলের গুণাগুণকে প্রভাবিত করে।
বাতাসে অধিক আদ্রতা ও বৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় মাল্টার খোসা পাতলা হয় এবং ফল বেশি রসালো ও নিম্ন মানের হয়। শুষ্ক আবহাওয়ায় ফলের মান ও স্বাদ উন্নতমানের হয়। আদ্র জলবায়ুতে রোগ ও ক্ষতিকর পাকার আক্রমণ বেশি হয়। মাল্টা গাছ আলো পছন্দ করে এবং ছায়ায় বৃদ্ধি ও ফলের গুণগত মান কমে যায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘বারী মাল্টা- ১’ নামে ২০০৩ সালে মাল্টার একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। এটির পাকা ফল দেখতে সবুজ ও খেতে সুস্বাদু। ফল গোলাকার ও মাঝারি (১৫০ গ্রাম) আকৃতির। পাকা ফলের রং সবুজ। ফলের খোসা মধ্যম পুরু ও শাসের সঙ্গে যুক্ত। শাস হলুদ, রসালো, খেতে মিষ্টি ও সুস্বাদু। গাছ প্রতি ৩০০-৪০০ ফল ধরে। হেক্টর প্রতি ফলন ২০ টন।
দেশের সব অঞ্চলে চাষের উপযোগী। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলে মাল্টা চাষে সফলতা পেয়েছেন চাষিরা। উৎপাদন খরচ কম এবং ফলটির স্বাদ ও ঘ্রাণ অতুলনীয় হওয়ায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে চাষের সম্ভাবনা। এরই মধ্যে মাল্টা চাষ করে লাভবান হয়েছেন চাষিরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানে উৎপাদিত মাল্টার স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাল্টার চেয়ে অনেক বেশি। আর আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণ অনুকূলে থাকায় মাল্টা চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের জামতলা এলাকায়, সর্বপ্রথম ২০১৩ সালে দুই বিঘা জমিতে তিন বছর বয়সী বারি-১ জাতের এই মাল্টা বাগানের মালিক মতিউর রহমান। ছোট বেলা থেকেই তার ছিল কৃষির প্রতি দুর্বলতা। অন্যের জমি লিজ নিয়ে তাই গড়ে তোলেন এই মাল্টা বাগান।
প্রথম দিকে ব্যর্থ হলেও সঠিক পরিচর্যা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আসে কাক্সিক্ষত ফল। আর সবুজ সেই মাল্টায় জীবনে নতুন করে আলোর দিশা দেখতে পান মতিউর রহমান। আর ছোট ছোট গাছে ঝুলছে থোকা থোকা মাল্টা। গাঢ় সবুজ রঙের মাল্টাগুলোয় এসেছে হলুদাভাব। আর বাগানে ঢুকতেই মাল্টার শোভা দেখে মন ভরে যায়। কেবল শোভা নয় এই বাগানের মাল্টা স্বাদেও বেশ মিষ্টি।
মাল্টা চাষি মতিউর রহমান জানান, তার এই সফলতা দেখে এখন অনেকেই শুরু করেছেন মাল্টার চাষ। চলতি বছর জেলায় ১৫০ বিঘা জমিতে মাল্টা চাষ হয়েছে। পাশাপাশি সৃষ্টি হয়েছে নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানও। ব্যক্তি পর্যায়ে বৃক্ষরোপণে অবদান রাখায় এ বছর পান প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার পান।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যান প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মো. জহুরুল ইসলাম জানান, শীতকালে লেবু জাতীয় দেশি ফল থাকে না বললেই চলে। সেক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনাময় বারি মাল্টা-১ লেবু জাতীয় ফলের উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
বিশ্বের প্রায় ৯০ ভাগ জ্যাম জেলি ও কমলার জুস মাল্টা থেকে আসে; তাই এই ফলের চাহিদা অপরিসীম উল্লেখ করে জহুরুল ইসলাম বলেন, দেশে অধিক হারে মাল্টা চাষের সম্প্রসারণ করা গেলে বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক অর্থের সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে অনেকের কর্মসংস্থানও হবে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক ড. মো. সাইফুর রহমান জানান, মাল্টা আমদানি নির্ভর একটি ফল। দেশে বাণিজ্যিকভাবে মাল্টার চাষ সম্প্রসারণ করা গেলে কমবে এ ফলের আমদানি, তেমনি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রফতানি কওে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
|