রানা প্লাজায় নিহতদের স্মরণ, ক্ষতিপূরণ বাড়ানোর দাবি
তারিথ
: ২৪-০৪-২০১৮
অনলাইন ডেস্ক :
রানা প্লাজা ধসের পাঁচ বছরে নিহতদের স্মরণ করেছেন স্বজন, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। তাদের স্মরণে ঘটনাস্থলে নির্মিত ‘অস্থায়ী শহীদ বেদিতে’ গতকাল মঙ্গলবার সকালে ফুল দেন তারা। প্রথমে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন; পর্যায়ক্রমে শ্রদ্ধা জানান নিহত ও আহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা। এ সময় তাদের অনেককে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায়। তারা সরকারের কাছে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার ফাঁসির দাবি জানান। এদিকে, রানা প্লাজা ধসে নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে দুর্ঘটনায় নিহতদের সন্তানদের আলোকবর্তিকা প্রজ¦ালন কর্মসূচিতে এই দাবি জানায় সংগঠনটি। এ সময় নিহতদের স্বজনরা যথাযথ ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি ওই দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান। জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, যেকোনো মূল্যে সব শ্রমিকের জন্য আমরা নিরাপদ কর্মস্থল দাবি করছি। রানা প্লাজা ও তাজরীনের নিহত, আহত ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের দাবি জানাচ্ছি। অনুষ্ঠানে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা যেকোনো মূল্যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিতের দাবি জানান। এ ছাড়া মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি প্রটেকশন স্কিম চালুর দাবি জানান শ্রমিক নেতারা। কর্মসূচি থেকে শ্রম আইনে আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের ধারা সংযোজনের দাবি জানানো হয়। এছাড়া ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাভারের সংসদ সদস্য এনামুর রহমানও আসেন রানা প্লাজা ধসে নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ রাসেল হাসান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রণব কুমার ঘোষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াব এ ভবন ধসের ঘটনা ঘটে। ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা নামে এই ভবনে ছিল বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা। ভবনটির ধ্বংসস্তূপ থেকে ১ হাজার ১৩৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। আহত হন দুই হাজারের বেশি শ্রমিক; যাদের অনেকে পঙ্গু হয়ে যান। এ ঘটনায় সাভার থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও অবহেলাজনিত’ হত্যার অভিযোগে মামলা করেন। দুই বছর পর ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন; মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে। সকালে সোহেল রানার ফাঁসি দাবিতে সাভার প্রবাসী শ্রমজিবী ফ্রন্টের (পার্বত্য চট্টগ্রাম) ব্যানারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। এছাড়া রানা প্লাজা ধসে নিহত ও আহত শ্রমিকদের স্মরণে সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এদিকে, সাভারে রানা প্লাজা ধসে আহত অনেকে এখনও পুনরায় কর্মসংস্থান করতে পারেনি। চাকরি পেয়েও ধরে রাখতে না পেরে হতাশায় ভুগছে আরো অনেকে। সেই সঙ্গে আছে নিত্য হাসপাতালে যাওয়ার ঝক্কি ও ব্যয়। পাঁচ বছর আগে এই দিনে ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণ করতে এসে আহতরা জানিয়েছেন তাদের বেঁচে থাকার গল্প; দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার কথা। তাদেরই একজন সাভার পৌর এলাকার রাতাশন মহল্লার নিলুফা বেগম (৩৮)। তিনি রানা প্লাজার আটতলায় প্যান্টন অ্যাপারেলসে সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন বলে জানান। নিলুফা বলেন, প্যান্টন অ্যাপারেলসে সাড়ে পাঁচ বছর কাজ করেছিলাম। আমার ও স্বামীর আয়ে ভালই চলছিল সংসার। দুর্ঘটনার দিন থেকে আমাদের স্বপ্নগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেল। ঘটনার আগের দিনই সবাই জানতে পেরেছিলাম ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ কারণে কাজে যেতে চাইনি। কিন্তু সুপারভাইজারের ফোন আর বেতনের হুমকিতে কাজে যেতে বাধ্য হই। সেই যাওয়া যে পুরোটা জীবন উজানে ঠেলে দেবে তা কে জানত। দুর্ঘটনার সময় তার পায়ের ওপরে একটি বিম পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, বিমের আঘাতে ডান পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। সাড়ে নয় ঘণ্টা পর আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে ন্যাশনাল মেডিকেল, বারডেম হাসপাতাল, মানসিক হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়। গত পাঁচ বছরে তিনি পায়ের চিকিৎসায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ, উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল, হেলটন হাপসাতাল, গণস্বাস্থ্য ও সিআরপিতে ছুটেছেন জানিয়ে বলেন, কিন্তু আজও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি সেই পা। প্রতিদিন ব্যথা ওঠে পায়ের সেই আঘাত পাওয়া জায়গাগুলোয়। আর এখন সেই পা মোটা হয়ে পচন ধরার উপক্রম। চিকিৎসকরা পা কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু টাকার অভাবে তাও করতে পারছি না। স্ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নিলুফা বলেন, বড় কষ্টের আর যন্ত্রণার এ জীবন। পাঁচ বছর ধইরা জেলখানায় আটকাইয়া আছি। এর চাইতে আমার মরণই ভালা আছিল। কথা বলতে বলতে অঝোরে চোখের পানি ঝরছিল নিলুফার। হঠাৎ থেমে গেলেন। কী বা লাভ এসব কথা কইয়া? গত ১৫ দিন ধরে নিলুফা কিডনির সমস্যায় ভুগছেন বলে জানান তার স্বামী শহীদুল ইসলাম। আগে তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন জানিয়ে শহিদুল বলেন, সরকার ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে তিন লাখ ৩০ টাকা সহযোগিতা পেয়েছেন নিলুফা। তা থেকে ৭৬ হাজার টাকা দিয়ে দোকান করেছিলেন। বাকি টাকা গেছে চিকিৎসায়। আর দোকান ভাল চলেনি। একসময় মালপত্র শুধু বিক্রি হয়েছে চিকিৎসার জন্য। নতুন করে কোনো মালপত্র কেনা হয়নি। এখন শুধু চা আর বিস্কিট বিক্রি হয় সেই দোকানে। তাতে যা আয় হয় তা দিয়ে মা, স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের দুমুঠো ভাত জোটানো কষ্টের হয়ে পড়েছে। তারা এখন নিঃস্ব বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, বিজিএমই থেকে জানানো হয়েছিল প্রত্যেক আহত শ্রমিককে সাড়ে আট লাখ করে টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু তা আর দেয়নি। দুর্ঘটনার আগে নিলুফা প্রতি মাসে কাজ করে পেতেন আট থেকে দশ হাজার টাকা। পাশাপাশি আমিও আয় করতাম। এ নিয়ে ভালই চলছিল সংসার। এখন দৈনিক ১০০ টাকাই আয় হয় না। পাঁচ বছরে নিলুফার চিকিৎসায় প্রায় চার লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যয় মেটাতে নিলুফা তার বাবার বাড়ির জমি বন্ধক রেখে ৫৫ হাজার টাকা এনেও চিকিৎসায় খরচ করেছেন। এ ছাড়া গত দুই বছরে সংসার ও চিকিৎসার খরচ চালাতে দুই লাখ টাকার মতো ঋণ হয়েছে। প্যান্টন অ্যাপারেলসে কাজ করতেন আরেক শ্রমিক নেছার উদ্দিন (৩৫)। দুর্ঘটনায় তিনি কোমরে আঘাত পান জানিয়ে বলেন, বছর খানেক আগে হাই পয়েন্ট গার্মেন্টে কাজ নিই। কিন্তু কোমরের চিকিৎসায় ছুটি নিতে চাইলে তারা আমাকে আর রাখেনি। দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকরা অনেক কারখানায় কাজের সন্ধ্যানে গেছে, কিন্তু রানা প্লাজার শ্রমিকরা আহত, তাদের ঘন ঘন ছুটি দিতে হবে এ কারণে তাদের চাকরিতে নেয় না। তাকে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যেতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর তিনি ৯৫ হাজার টাকা সাহায্য পেয়েছিলেন। তা খরচ হয়ে গেছে এক বছরেই। আহত তাজুল ইসলামকে (৩২) তার স্ত্রী ছেড়ে গেছে বলে তিনি জানালেন। এখন তিনি সাভারের একটি টেইলার্সে কারিগর হিসেবে কাজ করেন জানিয়ে বলেন, প্রতিদিন মজুরি যা পাই তাতে চলে যায়। কিন্তু আমার কষ্টটা হল - রানা প্লাজায় আহত হওয়ার মাস খানেক পর আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। সে আর ফিরে আসেনি। তাজুল আর কোনো জীবনসঙ্গী খোঁজেননি বলে জানান। রানা প্লাজায় নিউ ওয়ে স্টাইল নামের একটি পোশাক কারখানার আরেক অপারেটর ছিলেন শিউলী খাতুন (২৫)। বর্তমানে তিনি সাভারের আড়াপাড়ার জব্বারের বাড়িতে স্বামীর সঙ্গে ভাড়া থাকেন। স্বামী পেশায় দিনমজুর। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আমার কোমরের হাড় ভেঙ্গে গেছে। এরপর সিএমএইচে ২০ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর আমাকে নাটোরের রাধানগরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায় পরিবারের লোকজন। গ্রামের বাড়ি থাকার সময় স্বামী বিজিএমই, সাভার উপজেলা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় অনুদানের জন্য যোগাযোগ করলেও কোনো ধরনের সাহায্য পাননি। এমনকি রানা প্লাজায় কাজ করা শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও তাও আমার ভাগ্যে জোটেনি। অনেকেই বিভিন্ন রকম সহযোগিতা পেলেও শিউলী কেন পাননি সে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারেননি। সবাই অনেক টাকা-পয়সা পাইলো, কিন্তু আমার ভাগ্যে কিছুই জোটল না। কেউ খোঁজখবরও নেয় না। এখন চিকিৎসা করা দরকার কিন্তু তাও পারি না। মাঝে মাঝে কোমরের ব্যাথায় কোঁকাই। কে শোনে আমার দুঃখের কথা। কোমরে ব্যথার কারণে জোরে হাঁটতে পারেন না বলে তিনি জানান।