স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের আদালত অবমাননা সংক্রান্ত এক মামলার শুনানিকালে চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা বন্ধ রাখার প্রসঙ্গে হাইকোর্ট বলেছেন, চিকিৎসকদের হরতাল ডাকা ‘অন্যায়’। দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পাবলিক পারসেপশন ভালো না এবং চিকিৎসকদের ব্যবহারও ভালো না বলে এ সময় মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
গত মার্চে চুয়াডাঙ্গায় ‘ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টার’র চক্ষুশিবিরে অস্ত্রোপচারে ‘চোখ হারানো’র ঘটনায় করা রিট আবেদনের ওপর রুলের শুনানিতে সোমবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ এসব মন্তব্য করেন।
শুনানিতে আদালত বলেছেন, ‘ডাক্তাররা দেবতা নন। ভুল হবে সেটা স্বাভাবিক। ভুলটা অন্যায় নয়। কিন্তু ভুলটা জাস্টিফায়েড করার জন্য হরতাল ডাকা হলে সেটা অন্যায়।’
এ সময় আদালতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন। তার উদ্দেশে আদালত বলেন, ডাক্তারদের অবহেলা থাকলে তার যথাযথ শাস্তি হওয়া উচিত। কতিপয় দুর্বৃত্তের জন্য এই মহান পেশা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ধর্মঘট ডাকা প্রসঙ্গে আদালত বলেন, নিজেদের ভুল ঢাকতে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া আরো অন্যায়।
আদালত বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থাকতে র্যাবকে কেন অভিযান চালাতে হবে? তাহলে অধিদপ্তরের কাজ কী?
শুনানির শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ও চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ডা. মো. খাইরুল আলম রুলের বিষয়ে তাদের লিখিত জবাব দাখিলের জন্য সময় চেয়ে আবেদন করেন।
এর পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য শুনতে চান আদালত। শুরুতে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবর আবুল কালাম আজাদকে দেখিয়ে আদালত বলেন, চট্টগ্রামে (চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক মালিকরা চিকিৎসাসেবা বন্ধের ঘোষণা) যা করেছে সেটি দুঃখজনক। আজকের মামলার সঙ্গে এটি সম্পর্কিত নয়। কিন্তু যেহেতু আপনি (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক) আছেন, তাই বলছি। মানুষ বিপদে পড়লে তিন পেশার লোকের কাছে যায়- পুলিশ, আইনজীবী এবং ডাক্তার। তিনটি পেশা যদি কিছু কিছু দুর্বৃত্তের কারণে ধ্বংস হয়, তবে মানুষ বিপদে পড়বে। মেয়েটাকে (চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মারা যাওয়া রাফিদা খান রাইফা) তো ফিরিয়ে আনা যাবে না। ডাক্তাররা দেবতা নন। আমাদের (মানুষের) ভুল হবে বলে আমাদের একটা উচ্চ আদালত রয়েছে। ভুলটা অন্যায় নয়। কিন্তু ভুলটা জাস্টিফাই (যথাযথ) করার জন্য যদি হরতাল (ধর্মঘট) ডাকা হয় তবে তা অন্যায়।
আদালত আরো বলেন, কতিপয় দুর্বৃত্তের কর্মকাণ্ডের কারণে চিকিৎসাসেবার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। দেশে অনেক স্বনামধন্য চিকিৎসক এবং ভালোমানের চিকিৎসাসেবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভুল চিকিৎসার ভয়ে রোগীরা পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাচ্ছে। এতে দেশীয় মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। তাই এ ধরনের পরিস্থিতি কমিয়ে আনার জন্য আপনাকে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক) বলা হলো।
এর পর ডা. আবুল কালাম আজাদ আদালতকে বলেন, আমরা মহামান্য আদালতের সঙ্গে একমত। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। চট্টগ্রামে ইতিমধ্যে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গায় চিকিৎসা নিতে আসা চোখ হারানো ২০ জনের প্রসঙ্গে আবুল কালাম আজাদ আদালতকে বলেন, এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি করেছি। তারা ইতিমধ্যে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। আমরা পর্যালোচনা করছি। ইমপ্যাক্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে ওষুধের নমুনা আইসিডিডিআরবিতে পাঠায়। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী ওই ওষুধে ব্যাকটেরিয়ার নমুনা পাওয়া গেছে। কিন্তু আমাদের প্রতিবেদনে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। আমরা দুটো রিপোর্টই পর্যালোচনা করে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের চেষ্টা করছি।
পরে আদালত আগামী ১৬ জুলাই এ মামলায় জারি করা রুলের পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করেন। ডা. আবুল কালাম আজাদের উদ্দেশে আদালত বলেন, লিখিত জবাবে যেন ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটিত হয়। যাতে করে, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা যায়।
এই বলে আদালত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট অমিত দাসগুপ্ত।
গত ৩ জুলাই চুয়াডাঙ্গা শহরের ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে চক্ষুশিবিরে চিকিৎসা নিতে এসে চোখ হারানো ২০ জনের প্রত্যেককে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রুলের জবাব না দেওয়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনকে ব্যাখ্যা দিতে তলব করেন হাইকোর্ট।