অনলাইন ডেস্ক :
নিজেকে দেওয়া সংবর্ধনা বাংলাদেশের মানুষকে উৎসর্গ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অর্জনে অনন্য-অসাধারণ অবদানের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দেওয়া সংবর্ধনা গ্রহণ করে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ মনিহার আমায় নাহি সাজে, এটা জনগণের। আমার সংবর্ধনার প্রয়োজন নেই। আমি জনগণের জন্য কাজ করতে এসেছি। তাদের জন্য কাজ করছি। বাংলার মানুষ যেন অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান পায়, উন্নত জীবন পায়- সেটাই তার জীবনের লক্ষ্য জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জনগণের সেবক। জনগণের জন্যই কাজ করতে এসেছি। জনগণ কী পেল, সেটাই আমার কাছে বিবেচ্য। এ ছাড়া আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই আমার। গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন, অস্ট্রেলিয়ায় ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ এবং ভারতের কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট ডিগ্রি লাভসহ নানা অর্জনের জন্য সরকারপ্রধানকে সংবর্ধনা দিতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার আগে তার উদ্দেশ্যে মানপত্র পাঠ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পরে তিনি এই মানপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। প্রাপ্ত সংবর্ধনা বাংলার মানুষকে উৎসর্গ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এদেশের মানুষের ভাগ্য যেদিন পরিবর্তন হবে, সেদিন নিজেকে সার্থক মনে করবো। বাংলাদেশের মানুষ যা কিছু অর্জন করেছে, মহান ত্যাগের মাধ্যমেই অর্জন করেছে বলেও উল্লেখ করেন জাতির জনকের কন্যা। সংবর্ধনার শুরুতে পরিবেশন করা হয় জাঁকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বেলা সাড়ে ৩টায় অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। তিনি অতিথি মঞ্চে আসন নিলে অভ্যর্থনা সঙ্গীতের পাশাপাশি জাতীয় ও দলীয় পতাকা নেড়ে স্বাগত জানানো হয় শেখ হাসিনাকে। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে ‘শেখ হাসিনা, তোমার জন্য বাংলাদেশ ধন্য’ এই শিরোনামে একটিসহ দু’টি গান পরিবেশন করেন শিল্পী মমতাজ। দেশের ঐতিহ্য তুলে ধরে পরিবেশন করা হয় ‘আমার প্রিয় বাংলাদেশ’। এরপর প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে ‘রূপকাহিনীর রূপকথা’ শিরোনামে কবিতার সঙ্গে পরিবেশন করা হয় নৃত্য। দেশের জনপ্রিয় শিল্পীদের দলীয় সঙ্গীতের সঙ্গে নান্দনিক নৃত্যে সরকারপ্রধানের প্রশংসায় পরিবেশন করা হয় ‘তুমি শেখ হাসিনা, তুমি অনন্য’। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা হয়। মূল মঞ্চে আসন নেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা মানুষের তো দিনে ২৪ ঘণ্টা সময়। এই ২৪ ঘণ্টা সময় থেকে আমি মাত্র ৫ ঘণ্টা নেই। এটা আমার ঘুমানোর সময়। তিনি বলেন, এছাড়া প্রতিটি মুহূর্ত আমি কাজ করি দেশের মানুষের জন্য, দেশের জনগণের উন্নয়নের জন্য। এর বাইরে আমার জীবনে আর কোনো কাজ নেই। শেখ হাসিনা বলেন, আমি কোনো উৎসবে যাই না। সারাক্ষণ আমার একটাই চিন্তা-দেশের উন্নয়ন, দেশের মানুষের উন্নয়ন। তিনি বলেন, আমি নিজে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি কোথায়, কোন মানুষটা কি কষ্টে আছে। তাদের সমস্যার সমাধান করা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে পাওয়া রাজনৈতিক শিক্ষার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দেখেছি ছোটবেলা থেকে আমার বাবা কত ভালোবাসতেন এদেশের মানুষকে। দেখেছি মানুষের জন্য তার হাহাকার। এই মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কত পরিকল্পনা তার ছিলো। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে গড়ে তুলবো। প্রতিটি গ্রামকে শহরে গড়ে তুলবো আমরা। প্রতিটি গ্রাম হবে উন্নয়নের জায়গা, প্রতিটি গ্রামের মানুষ পাবে নাগরিক সুবিধা। ঠিক শহরের মানুষ যে সুবিধা পায়, সেইভাবে আমরা গ্রামের মানুষের অবস্থার উন্নতি করতে চাই। শিক্ষা-দীক্ষায় সব দিক থেকে বাংলার মানুষ উন্নত জীবন পাবে, ক্ষুধা আর হাহাকার থাকবে না। যারা বলে ‘নৌকা ঠেকাও’ তাঁদের লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে শেখ হাসিনা বলেন, তাহলে কি তারা ঐ রাজাকার এবং যুদ্ধাপরাধীদেরকেই আবার ক্ষমতায় বসাতে চান? প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে আবার একটা শ্রেণী রয়েছে যাদের কোন উন্নয়নই চোখে পড়ে না। আবার কেউ কেউ বলেন, নৌকা ঠেকাতে হবে। আমার প্রশ্ন নৌকা কেন ঠেকাতে হবে। নৌকা ঠেকিয়ে কি ঐ রাজাকারদের, যুদ্ধাপরাধীদেরকেই আবার ক্ষমতায় আনবেন? তাঁর লক্ষ্যটাই দেশের উন্নয়ন উল্লেখ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে যারা মনে করেন প্রবৃদ্ধি অর্জন ভাল নয়, দেশ উন্নয়নশীল হলে ভাল নয়, তাদেরকে আমার সন্দেহ হয়, তারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে কি না বা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে কি না। নাকি তারা ঐ স্বাধীনতা বিরোধীদের পদলেহনকারী সেটাই আমার প্রশ্ন। তিনি বলেন, এই নৌকায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার পেয়েছে, এই নৌকায় ভোট দিয়েছে বলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, এই নৌকায় ভোট দিয়েছিল বলেই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, এই নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিল বলেই বাংলাদেশ উন্নত হচ্ছে এবং আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উন্নীত হতে পেরেছি। তিনি বলেন, আমরা পরমাণু বিদ্যুৎ ক্লাবে পৌঁছাতে পেরেছি। আমরা স্যাটেলাইট যুগে পৌঁছাতে পেরেছি, আজ বাংলাদেশে দারিদ্রের হার ২২ ভাগে নেমে এসেছে এবং দারিদ্রের হার আরো হ্রাস করে বাংলাদেশকে আমরা দারিদ্রমুক্ত করতে পারবো ইনশাল্লাহ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ের বর্ণনা দেন শেখ হাসিনা। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথমবার ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কথা, পার্বত্য চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার রোধকারী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের কথা বলেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১-এ ক্ষমতায় আসতে পারিনি। নীতির সঙ্গে আপোশ করিনি বলেই ক্ষমতায় আসতে পারিনি। গ্যাস বিক্রির আপোশ করার প্রস্তাব ছিল, কিন্তু তা না করাতেই তিনি ক্ষমতায় আসতে পারেননি বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা বিএনপি-জামায়াতের সরকার দেশে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মানি লন্ডারিং করে। বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদে দেশের মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়ায় তাঁর দল আবার ক্ষমতায় আসে। বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে অগ্নিসন্ত্রাস হয় বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং রায়ের ফলে বাংলাদেশ কলুষমুক্ত হয়েছে। এগিয়ে যাওয়ার পথ পেয়েছে। উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। দুই মেয়াদের সরকারে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ের বর্ণনা দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ৬৮ বছরের সমস্যা ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেছি। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার সমস্যা সমাধান করেছি। আজ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশে ৫৩তম দেশ হিসেবে যোগ দিয়েছে পরমাণু ক্লাবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছি। এর মধ্য দিয়ে স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নানা অর্জনের কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বিশ্বমন্দার প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে দিইনি। প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৭ ভাগে উন্নীত হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ ভাগে নামিয়ে আনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করলে কারও কারও আঁতে ঘা লাগে। শেখ হাসিনার ভাষণে আসে জঙ্গিবাদ ও মাদক প্রসঙ্গও। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের যে বীজ বিএনপি বপন করেছিল, তা থেকে মুক্ত করতে চেষ্টা চলছে। মাদককে দেশ ও সমাজের জন্য ভয়াবহ বিষ হিসেবে তুলনা করে শেখ হাসিনা বলেন, মাদকের প্রভাব থেকে সমাজ ও দেশকে মুক্ত করতে হবে। দুস্থ ও প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নে তাঁর সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় ৪০ লাখ বয়স্ক মানুষ, ১২ লাখ বিধবা, ১০ লাখ প্রতিবন্ধীকে প্রতি মাসে ৭০০ করে টাকা দেওয়া হচ্ছে। সরকার ২ কোটি ৪ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেয় বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, অনগ্রসর সব শ্রেণি ও পেশার মানুষকে যে ভাতা দেওয়া হয়, তা মুঠোফোনের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণের শেষ দিকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি বরদাশত করব না। এগিয়ে চলার পথ যেন অব্যাহত রাখতে পারি, সে জন্য দেশের মানুষের দোয়া চাই। উন্নয়ন ও অর্জনে অসাধারণ সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দিতে আয়োজিত জনসমুদ্রে রূপ নেওয়া সমাবেশে সকাল থেকেই জনতার ঢল নামে। লাল টি-শার্ট, মাথায় সবুজ ক্যাপ, হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে উদ্যানের সবুজ চত্বর থেকে শুরু করে শাহবাগ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর আশপাশের এলাকায় জনতার ঢল নামে। নৌকা প্রতিকৃতি নিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, নেচে-গেয়ে জনসভায় আসেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। খ- খ- মিছিল, ট্রাক-পিকআপ ভ্যানে চেপে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হন তারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাপিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকাগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, লাল-সবুজের রঙিন পোশাক পরে উদ্যানে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। জয় বাংলা ও শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নামে নানা স্লোগানে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয় গোটা এলাকায়। সমাবেশ প্যান্ডেলটি কয়েকটি অংশে ভাগ করা হয়। প্যান্ডেলের বিভিন্ন অংশে স্থাপন করা হয় বড় বড় প্রজেক্টর। উদ্যান এলাকার পাশাপাশি রাজধানীর বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, পল্টন, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, জাতীয় সংসদ ভবন, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় নানা ধরনের সাজসজ্জা করা হয়। জাঁকজমক সাজসজ্জার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় নৌকার প্রতিকৃতি।
|