আসন্ন কোরবানী ঈদকে ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট সিন্ডিকেটের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জুলাই মাসেই রাজধানীতে পৃথক দু’টি অভিযানে জাল নোট কারবারী চক্রের ৬ জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। ওই সময় তাদের কাছ থেকে ৩৯ লাখ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা জাল নোটমুক্ত বাজারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। মূলত জাল নোটসহ গ্রেফতারকৃতদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া এবং আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলে সহজে বের হওয়ার কারণে তাদের স্থায়ীভাবে প্রতিহত করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিবছরই বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে বাজারে অর্থের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। জাল নোটের কারবারীরা মূলত ওই বিষয়টি মাথায় রেখে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঈদুল আযহা উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে বিভিন্ন মূল্যমানের নতুন টাকার নোট ছাড়বে। আর ওই সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকা জাল নোট প্রস্তুকারী চক্র ও ব্যবসায়ীরা মাঠে নামবে। তাদের মূল টার্গেটই হচ্ছে ঢাকাসহ বড় বড় শহর ও উপজেলা পর্যায়ে পশুরহাট। ওসব অসাধু কারবারীদের প্রতিরোধে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু জাল নোটের উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা গ্রেফতারের কয়েকদিনের মধ্যেই আইনের ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে। তাছাড়া অপরাধের তুলনায় শাস্তি কঠোর না হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে তারা আবারো একই ব্যবসা শুরু করে। ফলে ওই চক্রকে ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নিয়েও পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। সূত্র জানায়, বছরজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জাল নোট চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার আগে অভিযান জোরদার করা হয়। কারণ তখন জাল নোটের প্রতিটি চক্র সক্রিয় হয়ে পড়ে। আশঙ্কা করা হচ্ছে আসন্ন ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই অনেক জাল নোট কারবারী রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট কোরবানীর পশুরহাটগুলো। জাল নোট উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ১ হাজার ৮৫টি অভিযান চালিয়েছে র্যাব। অভিযানে ১ হাজার ৭৫১ জন জাল নোট উৎপাদক ও ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। মামলা হয় ১ হাজার ৩২টি। অভিযানে জাল নোট তৈরিতে ব্যবহৃত কম্পিউটার ও বিভিন্ন সরঞ্জামসহ মোট ৯ কোটি ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৪২৪ টাকা মূল্যমানের বাংলাদেশী জাল নোট উদ্ধার করা হয়। দেশীয় জাল নোটের পাশাপাশি বাহিনীটি বিপুল পরিমাণ বিদেশী জাল নোটও উদ্ধার করে। এলিট ফোর্স র্যাবের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ৮ লাখ ৩৮ হাজার ভারতীয় রূপি, ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯২ ইউএস ডলার, ৪৭ হাজার ইউরো, ১৫ হাজার ১৮০ সউদী রিয়াল, ইরাকি দিনার ১৫ হাজার, মিয়ানমারের কোয়াট ২ লাখ, মালয়েশিয়ান রিংগিত ৩ হাজার ৪৫১ হাজার, পাকিস্তানি রুপি, ও তুরস্কের আড়াই লাখ টাকার সমপরিমাণ জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য দেশের আরো ৪ লাখ ১৬ হাজার ৯১৭ টাকার সমমূল্যের জাল নোট উদ্ধার করে র্যাব। সূত্র আরো জানায়, শুধু বাংলাদেশী নয়, ইতোপূর্বে জাল নোট কারবারে জড়িত অনেক বিদেশী নাগরিককেও আটক করা হয়েছে। তাদের কেউ সরাসরি উৎপাদন, কেউ বাজারজাত প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। রাজধানীর জাল নোট চক্রের প্রশিক্ষিত মূল হোতাদের রয়েছে অত্যাধুনিক মেশিন ও যন্ত্রপাতি। তারা বিভিন্ন ধাপে জাল নোট উৎপাদন থেকে বাজারজাত প্রক্রিয়া মনিটরিং করে। জাল নোট কারবারে যুক্ত সদস্যদের বলা হয় কম্পানি। কয়েকজন সদস্য নিয়ে একটি কম্পানি গঠিত। তারা কয়েকটি ধাপে কাজ করে। তার মধ্যে প্রথম কাজ হল- ঈদের আগে ব্যাংকগুলো নতুন নোট ছাড়লে সঙ্গে সঙ্গে সংগ্রহ করা। পরবর্তীতে ওসব নোটের হুবহু জাল নোট তৈরি করা। ওসব নোট পাইকারি ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেয় চক্রের দ্বিতীয় সারির লোকেরা। ওই ক্ষেত্রে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি ১ লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি হয় ৮/১০ হাজার টাকায়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করে ১২/১৫ হাজার টাকায়। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রতি ১ লাখ জাল নোট মাঠ পর্যায়ের এজেন্টদের কাছে বিক্রি করে ১৮/২০ হাজার টাকা করে। মূলত জাল নোটের নির্দিষ্ট কোন বাজার মূল্য নেই। এটি নির্ভর করে কাগজ ও উৎপাদনের মানের ওপরে। কাগজের মান ভালো হলে দাম বাড়ে। আর কাগজের মান তুলনামূলক মাঝারি ধরণের হলে দামও কমতে থাকে। এদিকে বিগত ১৯ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে জাল নোট চক্রের ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৩২ লাখ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় মামলা করা হয়েছে। গ্রেফতার ওই ৪ জন প্রায় বছর ধরে জাল নোট প্রস্তুত ও বাজারজাত করে আসছে। কল্যাণপুরের অভিযানের কয়েকদিন আগে ৪ জুলাই রামপুরা থেকে গ্রেফতার করা হয় দুই জাল নোট কারবারীকে। তাদের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এ প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, বিভিন্ন সময়ে জাল নোট কারবারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে আটক, মেশিন ও সরঞ্জাম উদ্ধার এবং তাদের বহু আস্তানা ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকদিন না যেতেই জামিনে বেরিয়ে এসে তারা একই ব্যবসা শুরু করে। যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এবং কারাগার থেকে মুক্তির পর তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা গেলে জাল নোট চক্রকে নির্মূল করা সম্ভব। একই প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মো. মাসুদুর রহমান জানান, ঈদের আগে জাল নোট কারবারীদের তৎপরতা বেশি দেখা যায়। সেজন্য অভিযানও চলে বেশি। জাল নোট কারবারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চললে ঝুঁকি অনেকটা দূর করা সম্ভব।