ঢাকায় বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের প্রতিবাদে ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর বাইরেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবরোধ-বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর: সাভার: সাভারে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছে। গতকাল বুধবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে সাভার বাসস্ট্যান্ডে নিউ মার্কেটের সামনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় তারা। কয়েকজন ঢাকামুখী কয়েকটি যানবাহনে ইটপাটকেল ছুড়ে ও লাঠি দিয়ে ভাংচুর করে। তবে ঘটনাস্থলে পুলিশ জড়ো হওয়ায় তারা অল্পতেই দমে যায়। ঢাকা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের ওসি এএফএম সায়েদ বলেন, তারা ভাংচুরের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পুলিশের উপস্থিতির কারণে পারেনি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। পরে ঢাকার (উত্তর) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দিলে তারা মিছিল করতে করতে সিঅ্যান্ডবির দিকে চলে যায়। এদিকে রাজধানীর প্রবেশদ্বার আমিনবাজারে মিরপুর মফিদ-ই-আম স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আারিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। বিক্ষোভ চলার সময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়। বিকালের দিকে জট কমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। গাজীপুর: ঢাকায় বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের প্রতিবাদ ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে গাজীপুরে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রাসেল শেখ জানান, শিক্ষার্থীরা গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টঙ্গীর কলেজ গেইট, কোনাবাড়ি ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিক্ষোভে নামে। বিভিন্ন কলেজ ও স্কুলের শত শত শিক্ষার্থী বিক্ষোভ দেখানো ছাড়াও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। পরে তারা ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে। বেলা দেড়টা পর্যন্ত চলে তাদের কর্মসূচি। এ সময় দুই সড়কে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তবে শিক্ষার্থীরা কোথাও কোনো ভাংচুর করেনি। পরে পুলিশ যাত্রীদের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরলে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেয় বলে তিনি জানান। ভাওয়াল মির্জাপুর কলেজের সহকারী অধ্যাপক ইসমতারা বলেন, কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মূখে পড়েছিলেন তিনিসহ তার কয়েক সহকর্মী। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে পোড়াবড়ি এলাকায় পৌঁছালে আমাদের বহনকারী লেগুনা গন্তব্যের দিকে না গিয়ে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে মহাসড়কে নামিয়ে দেয়। পরে আমরা প্রায় দুই কিলোমিটার হেঁটে রিকশায় করে বিকল্প পথে বাসায় পৌঁছাই। এসবের দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত। দ্রুত একটা রফা হওয়া উচিত। ময়মনসিংহ: ঢাকায় বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে ময়মনসিংহে বিক্ষোভ দেখিয়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার বেলা ১১টার দিকে জেলা শহরের নতুর বাজার, গাঙ্গিনাপাড় ও পাটগুদাম ব্রিজ মোড় এলাকায় বিক্ষোভ দেখায় তারা। বিক্ষোভ চলার সময় তারা কয়েকটি অটোরিকশা ও প্রাইভেট কারের কাচ ভাংচুর করেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। কোতোয়ালি থানার ওসি মাহমুদুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিক্ষোভ দেখায়। এ সময় তারা ‘কয়েকটি’ অটোরিকশা ও প্রাইভেটকারে ইট নিক্ষেপ করলে কাচ ভেঙে যায়। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। বিক্ষোভ চলার সময় শহরের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ ছিল। বেলা ২টার দিকে আবার দোকানপাট খোলা হয়। রোববার জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় ঢাকায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এরপর তিন দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ চালিয়ে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ কয়েক জায়গায় বিক্ষোভ দেখায় শিক্ষার্থীরা। বরিশাল: রাজধানীতে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় নয় দফা দাবিতে বরিশালে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বরিশাল নগরের চৌমাথা এলাকার ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে তারা এ বিক্ষোভ করে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের ফলে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে দুপুর সোয়া ২ টার দিকে কর্মসূচি প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীরা। এদিকে, কর্মসূচি শুরুর দিকে কোতোয়ালি থানার এসআই হাবিব শিক্ষার্থীদের গালাগাল ও তাদের সঙ্গে অসদাচরণের কারণে তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অপরদিকে, অবরোধের ফলে মহাসড়কের দু’পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে সাধারণ যাত্রীরা বিপাকে পড়ে যায়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানায়, নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে বেলা ১২টার দিকে বরিশালের সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, অমৃত লাল দে কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি মডেল কলেজ, ইনফ্রা পলিটেকনিক কলেজসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকশ’ শিক্ষার্থী নগরের চৌমাথা এলাকায় আসেন। এসময় তারা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই নয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করে। কিছু সময় পরে তারা একটি মিছিল বের করতে চাইলে এসআই হাবিবসহ পুলিশ সদস্যরা তাদের বাধা দেন। পরে পুলিশের এসআই হাবিব শিক্ষার্থীদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও তাদের মারতে উদ্যত হন। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্দ হয়ে দুপুর ১টার দিকে মহাসড়ক অবরোধ করে। শিক্ষার্থীরা জানায়, ঘটনাস্থলে মেট্রোপলিটন পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার শাহানাজ পারভীন ও কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল ইসলাম উপস্থিত হয়ে আমাদের (শিক্ষার্থীদের) সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করেন এবং পুলিশের দেওয়া আশ্বাসে বেলা সোয়া ২টার দিকে মহাসড়কের অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। তবে তারা সহপাঠীদের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত চালক ও হেলপারের উপযুক্ত শাস্তিসহ নিরাপদ সড়কের জন্য সুনির্দিষ্ট আশ্বাস চেয়েছেন। একইসঙ্গে বরিশালের সড়কে চলাচলরত যানবাহনের চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও দক্ষতার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া ও নগরের বিভিন্নস্থানে যত্রতত্রভাবে গড়ে উঠা অটোরিকশা ও থ্রি-হুইলার স্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়। বরিশাল সরকারী সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের শিক্ষার্থী সুহাদ বলেন, সহপাঠী নিহত হওয়ার ঘটনায় দোষী চালকদের বিরুদ্ধে ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় পুনরায় চৌমাথা এলাকায় কর্মসূচি পালন করা হবে। বরিশাল কোতয়ালি মডেল থানার সেকেন্ড কর্মকর্তা সত্য রঞ্জন খাসকেল বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পুলিশের এক কর্মকর্তা গালাগাল করেছেন বলে অভিযোগ উঠে। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসআই হাবিব নামের ওই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করেছেন। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে। খুলনা: নিরাপদ সড়কের দাবিতে খুলনায় রাজপথে নেমেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার দুপুরে মহানগরীর শিববাড়ী মোড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এক মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এ সময় সরকারের কাছে নিরাপদ সড়কের স্বার্থে ১৫ দফা দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলো হচ্ছে- বেপোরোয়া গাড়ির চালককে ফাঁসি দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিড ব্রেকার দিতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীর পরিবারের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে, শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে, থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে; শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে; ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবে না; বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না; নির্দিষ্ট বয়সসীমা ছাড়া ড্রাইভার হিসেবে গাড়ি চালানো যাবে না; জেব্রা ক্রসিং দিতে হবে, ট্রাফিক পুলিশের সচেতনতা, কাজের প্রতি দায়িত্ব বাড়াতে হবে; পরিবহনে যৌন হয়রানি বন্ধ করতে হবে এবং এটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে শাস্তি দিতে হবে; গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায়,স্কুল-কলেজ হাসপাতালের সামনেও সকল গাড়ির স্পিড লিমিট থাকতে হবে; নিদির্ষ্ট সংখ্যক লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইজিবাইক ছাড়া খুলনার রাস্তায় ইজিবাইক চলবে না; যেখানে সেখানে গাড়ি পার্ক করা যাবে না; উচ্ছৃংখল মোটরসাইকেল আরোহীদের জরিমানাসহ শাস্তি দিতে হবে। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন শিক্ষার্থী রাসেল মাহমুদ, সুদীপ কুমার, সোহানুর বাবুল প্রেম, ফাতেমা-তুজ-জোহরা, বন্যা, শামীম, মুজাহিদুল, কিশোর কুমার বাড়ৈ প্রমুখ। এ সময় বক্তারা বলেন, শিক্ষার্থীদের ৯দফা দাবিতে আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। সেই সঙ্গে আমরা ১৫দফা দাবি জানাচ্ছি। প্রত্যেকটি দাবি যৌক্তিক। শিক্ষার্থীদের এসব দাবি বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া ঢাকায় আন্দোলনরত খুদে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদ জানান তারা।