সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বহু আলোচিত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করেছে সরকার। রোবববার সকালে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৯০৮ পৃষ্ঠার এই রিভিউ আবেদন জমা দেওয়া হয় বলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল জানান। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম পরে সাংবাদিকদের বলেন, এই রিভিউ আবেদনে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরেছে। রায়ে যেসব অপ্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা এসেছে, তা বাতিল চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণ সংক্রান্ত আইন হওয়ার আগেই আপিলের রায়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে- যা আমাদের কাছে অপরিপক্ক মনে হয়েছে। রিভিউ আবেদনে আমরা ওই রায় বাতিল চেয়েছি। মাহবুবে আলম বলেন, আশা করি ৯৪টি গ্রাউন্ড বিবেচনায় নিয়ে আপিল বিভাগ রায় পুনর্বিবেচনা করবে এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বহাল থাকবে। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবীর এক রিট আবেদনে হাই কোর্ট ২০১৬ সালে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের আপিল বিভাগ গত ৩ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে দিলে হাই কোর্টের রায়ই বহাল থাকে। ওই রায়ের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গে বিচারকদের জন্য একটি আচরণবিধিও ঠিক করে দেওয়া হয়। সাত বিচারপতির ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেওয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায়ে তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন। ওই রায় এবং পর্যবেক্ষণ নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে ‘খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা। তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বিচারপতি সিনহা গত ৩ অক্টোবর থেকে ছুটিতে যান। তিনি দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার দেন রাষ্ট্রপতি। প্রধান বিচারপতিকে ‘জোর করে’ ছুটিতে পাঠানো হয়েছে- বিএনপির এমন অভিযোগের মধ্যেই ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন বিচারপতি সিনহা। ছুটি শেষে ১০ নভেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে হাই কমিশানারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে নিজের পদত্যাগপত্র পাঠান বিচারপতি সিনহা। এর আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন সংসদে বলেন, আদালত তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সংসদে আনা সংবিধান সংশোধন বাতিলের ওই রায় দিয়েছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পর্যালোচনা ও পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে সহকর্মীদের নিয়ে অক্টোবরের শুরুর দিকে ১১ সদস্যের কমিটি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল রোববার সেই আবেদন জমা দেওয়া হল। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে অবকাশ চলছে। এই অবকাশ শেষে ২ জানুয়ারি আদালত খোলার পর নিয়ম অনুযায়ী সরকারের রিভিউ আবেদন কার্যতালিকায় আসবে। শুনানি কবে হবে- তা জানা যাবে তখনই। আপিল বিভাগের যে সাত বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা অবসরে গেছেন, আর বিচারপতি এস কে সিনহা পদত্যাগ করেছেন। ফলে আপিল বেঞ্চে এখন বিচারক আছেন পাঁচজন। গত অক্টোবরের শেষে অ্যাটর্নি বলেছিলেন, রিভিউ ফাইল করা হলেও নতুন বিচারপতি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত রিভিউ শুনানি করার সম্ভবনা নেই, এটাই আমি মনে করছি। তবে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, রিভিউ শুনানিতে সাত বিচারপতি থকতে হবে সুপ্রিম কোর্ট রুলসে এমন কোনো কথা নেই আমার জানামতে। এমন অনেক রিভিউ আছে যেখানে অনেকেই অবসরে গেছেন কিন্তু রিভিউ শুনানি হয়েছে।