বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নব পর্যায়ের বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতা। হিমাদ্রী শিখর সফলতার মূর্ত-স্মারক, উন্নয়নের কাণ্ডারি। উন্নত-সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার একান্ত বিশ্বস্ত ঠিকানা, বাঙালির বিশ্বজয়ের স্বপ্ন-সারথী। বিশ্বরাজনীতির উজ্জ্বলতম প্রভা, বিশ্ব পরিমণ্ডলে অনগ্রসর জাতি-দেশ-জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র, বিশ্বনন্দিত নেতা। বারবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা ‘নীলকণ্ঠ পাখি’, মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তমানবী। তিমির হননের অভিযাত্রী, মাদার অব হিউম্যানিটি। আত্মশক্তিসমৃদ্ধ সত্য সাধক। প্রগতি-উন্নয়ন শান্তি ও সমৃদ্ধির সুনির্মল মোহনা। এক কথায় বলতে গেলে সমুদ্র সমান অর্জনে সমৃদ্ধ শেখ হাসিনার কর্মময় জীবন।
স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার জ্যেষ্ঠ সন্তান এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিন আজ। তিনি চারবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড গড়েছেন। প্রায় তিন দশক ধরে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জ্যোতির্ময় এক মানবকন্যার জন্ম হয়, তার নাম শেখ হাসিনা। মানব দরদি শেখ হাসিনার জন্মক্ষণ বাঙালি জাতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। তার দক্ষ, বিচক্ষণ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। উন্নয়নের রোল মডেল। তার হাত ধরেই উন্নত সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশ। গ্রামবাংলার কাদামাটি, পাখপাখালির কলতান আর গ্রামের সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে শৈশব কেটেছে তার। পরে ঢাকায় এসে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। পরিবার থেকেই রাজনীতির প্রথম পাঠ চুকিয়ে ফেলেন তিনি। কিশোর বয়স থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ছয় দফা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৫৪ সালে মাত্র ৭ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসেন শেখ হাসিনা। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তখন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথমে পুরান ঢাকার মোগলটুলির রজনী বোস লেনে বসবাস শুরু করেন তারা। পরে বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচিত হলে ৩ নম্বর মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে ওঠেন। ১৯৫৬ সালে টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন শেখ হাসিনা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের নাম শেরেবাংলা বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার। ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। ১৯৬৭ সালে ঢাকার বকশী বাজারের ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এ কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজছাত্র সংসদের সহ-সভানেত্রী (ভিপি) পদে নির্বাচিত হন। তিনি এ কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি ছিলেন। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৩ সালে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
জেলবন্দি পিতার আগ্রহে ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন শেখ হাসিনা। ১৯৬৯ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রবল আকার ধারণ করে। ১৯৬৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি পেশ করে। এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যায়। সে সময় বঙ্গবন্ধুর গোটা পরিবারকে ঢাকায় একটি বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই গৃহবন্দি অবস্থায় শেখ হাসিনার কোলজুড়ে আসেন প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়। বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পরিবারের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সন্তান সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
মাত্র ২৮ বছর বয়সে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটের গুলিতে পিতা-মাতা, ভাই, ভাবিসহ পরিবারেরব সবাইকে হারান তিনি। সৌভাগ্যক্রমে দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৭৫ সাল থেকে দীর্ঘ ৬ বছর দেশের বাইরে নির্বাসিত জীবন কাটান জাতির পিতার দুই কন্যা। জাতির পিতাকে হারিয়ে বাংলাদেশে তখন ঘোর আমাবস্যা। উল্টোপথে হাটতে থাকে দেশ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়া হয়। সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। কালিমা লেপন করা হয় সংবিধানের ৪ মূলনীতির উপরে। সেনা শাসকের কবলে পড়ে দেশ।
মাত্র ৩৪ বছর বয়সে দেশ ও বাঙালি জাতির প্রয়োজনে শিশুপুত্র-কন্যার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরেন তিনি। শেখ হাসিনাকে সেদিন প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানাতে ঢাকার সব প্রান্ত, অলিগলি, গিরিপথ ও রাজপথ পেরিয়ে আসা অগণিত মানুষের ভিড়ে তরঙ্গায়িত হয় বিমানবন্দর। বাঁধভাঙা স্রোতের মতো ছুটে যেতে থাকে তারা। মানুষের সেই মিছিলে ছিল অগণিত নারী, পুরুষ, যুবক ও বৃদ্ধ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ তাদের মুক্তিদূতকে স্বচক্ষে একপলক দেখার জন্য সমাবেত হয় বিমানবন্দরে। সেদিন গগনবিদারী মেঘের গর্জন, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেন জাতির পিতা হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য গর্জে উঠেছিল। মুষলধারে বর্ষণ যেন শেখ হাসিনার চরণচুমে তাকে বরণ করে নিচ্ছিল। লাখ-লাখ কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম পিতৃহত্যার বদলা নেব’। পিতৃহত্যার বদলা নয়, বাংলার জনগণের কাছে বিচার চাইলেন তিনি। অশ্রুসিক্ত নেত্রে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আপনাদের কাছে আমি বিচার চাই। দেশের বর্তমান দুর্বিষহ অবস্থার জন্য যারা দায়ী জনগণের কাছে তাদের বিচার চাই। খুনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে যে সরকার, তারা জনগণের কল্যাণ করতে পারে না।’নৌকার হাল ধরে বাঙালির ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পথে হাঁটতে থাকেন তিনি। সেনা শাসকের বুটের তলায় পিষ্ট গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার ও আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে বাংলার আনাচে-কানাচে ছুটতে থাকেন অবিরত। ৬৮ হাজার গ্রাম শেখ হাসিনার পদধুলি পেয়ে ধন্য হয়।
শেখ হাসিনার উপরে প্রথম হামলা হয় ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার বছর। তার ওপর হামলা করে ফ্রিডম পার্র্টির সন্ত্রাসীরা। মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে ১৯৮২ সালে এরশাদবিরোধী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৮৩ সালে তিনি ১৫ দলের একটি জোট গঠন করেন। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের ৩১ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। চোখ বেঁধে তাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে তিনি আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের কংগ্রেসে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সালে ইয়াসির আরাফাতের আমন্ত্রণে তিউনিশিয়ায় ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার সদর দপ্তর সফর এবং মধ্যপ্রাচ্য শান্তি-প্রক্রিয়ার বিষয়ে মতবিনিময় করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি হজ পালন করেন। ১৯৮৬-র সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ফের আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে গৃহবন্দি করা হয়।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মিছিলে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশ ও বিডিআর এলোপাতাড়ি নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় অল্পের জন্য শেখ হাসিনার জীবন রক্ষা হলেও নিহত হন ৯ জন নেতাকর্মী। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টায় শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ফ্রিডম পার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে হামলা চালায়। হামলাকারীরা বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালায় ও একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তবে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়নি। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর আন্দোলনের জোয়ার ঠেকাতে সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় এবং শেখ হাসিনাকে ধানমন্ডির বাসায় গৃহবন্দি অবস্থায় রাখা হয়। ৪ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দেন শেখ হাসিনা। পতন ঘটে এরশাদ সরকারের।
১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সংসদ উপনির্বাচনের সময় সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যার উদ্দেশে গুলি করে। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর তিনি সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালের ৭ মার্চ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০০ জন সংসদ সদস্য শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গোলাম আযমকে গণআদালতে বিচারের দাবির সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করেন।
১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল করে গোলাম আযমের বিচার করার প্রস্তাব দেন শেখ হাসিনা। ১৯৯২ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৯৩ সালে চীন সফর করেন তিনি। ১৯৯৩ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার জনসভায় গুলি ও বোমা হামলায় ২৪ জন নিহত ও অসংখ্য লোক আহত হন। তিনি ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে’ রূপান্তর করেন। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার ট্রেন অভিযাত্রায় ঈশ্বরদী ও নাটোরে ব্যাপক সন্ত্রাস, গুলি, বোমা হামলা ও তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। ১৯৯৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা মিন্টো রোডের বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবন ত্যাগ করেন।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯৬-২০০১ পাঁচ বছর ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল সময়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা, ১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করাসহ বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়।
এ সময় দ্রব্যমূল্য ছিল ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্যে সার, বীজ সরবরাহ এবং সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের ফলে দেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় ২৬০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। প্রথম মুঠোফোন (মোবাইল) প্রযুক্তির বাজার উন্মুক্ত এবং উল্লেখযোগ্য হারে কর সুবিধা প্রদান করা হয়। বেসরকারি খাতে টেলিভিশন চ্যানেল পরিচালনা করার অনুমতি প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কম্পিউটার আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাসকরণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাতে হাতে তথ্যপ্রযুুক্তির সুযোগ পৌঁছে দেওয়া হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে বাঙালি জাতির ললাট থেকে বিচারহীনতার কলঙ্ক মোচনের পদক্ষেপ নেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সংসদে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তিনি পানি প্রবাহ ৪২ হাজার কিউসেক থেকে ৮২ হাজার কিউসেকে উন্নীত করেন।
১৯৯৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যলয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মান সূচক ‘ডক্টর অব লজ’ উপাধি প্রদান করে। ১৯৯৭ সালের ৬ ও ৭ মে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে গঠিত উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম ‘বিমসটেক’-এ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯৭ সালের ১৫ জুলাই জার্মানির হামবুর্গে ইউনেস্কোর উদ্যোগে আয়োজিত পঞ্চম আন্তর্জাতিক বয়স্ক শিক্ষা সম্মেলনে যোগদান এবং সম্মেলনের মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন। একই বছরের ২৫ অক্টোবর গ্রেট ব্রিটেনের ডান্ডি অ্যাবার্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি ‘ডক্টর অব লিবারেল আর্টস’ ডিগ্রি লাভ করেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মশতবার্ষিকীতে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস কমিটি তাকে ‘নেতাজী মেমোরিয়াল পদক ১৯৯৭’ প্রদান করেন। ১৯৯৭ সালে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন শেখ হাসিনাকে ‘পল হ্যারিস ফেলো’ নির্বাচিত করে এবং ৯৬-৯৭ সালের সম্মাননা মেডেল প্রদান করে। একই বছর লায়ন্স ক্লাবসমূহের আন্তর্জাতিক অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক ‘রাষ্ট্রপ্রধান পদক’-এ ভূষিত হন তিনি। ১৯৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি শান্তি নিকেতনে বিশ্বভারতীর এক আড়ম্বরপূর্ণ বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ‘শান্তিবাহিনীর’ প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন। পাবর্ত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রাখার জন্য জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো শেখ হাসিনাকে ১৯৯৮ সালের ফেলিক্স হুফে বইনি শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৯৮ সালের ১২ এপ্রিল শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য তাকে ‘মাদার তেরেসা পদক’ প্রদান করে নিখিল ভারত শান্তি পরিষদ।
নরওয়ের রাজধানী অসলোয় অবস্থিত মহাত্মা গান্ধী ফাউন্ডেশন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯৯৮ সালের ‘এমকে গান্ধী’ পদক প্রদান করে। ১৯৯৯ সালে ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি কর্তৃক ‘সেরেস পদক’ লাভ করেন তিনি। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অসাধারণ অবদান রাখায় ১৯৯৯ সালের ২০ অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি শেখ হাসিনাকে ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৯৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করে।
এ সময় একের পর এক মর্যাদার স্মারক যুক্ত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সাফল্য-গাঁথায়। ২০০০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসের ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় শেখ হাসিনাকে ‘Doctor Honoris Causa’ প্রদান করে। ২০০০ সালে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার জন্য ম্যাকন ওমেনস কলেজ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ‘পার্ল এস বাক পদক’ লাভ করেন তিনি। ২০০০ সালে আফ্রো-এসিয়ান ল’ ইয়ার্স ফেডারেশন প্রদত্ত ‘পার্সন অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু তখনও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। ২০০০ সালে মুফতি হান্নান তার সহযোগীদের নিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে কোটালিপাড়ায়।
২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আবারও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক নির্বাচনি কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি পদে আবারও নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এ হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। ওই ঘটনায় সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবাণীতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। মারাত্মক আহত হন তিনি।
১/১১-এর পর শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য হাজির করা হয় ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’। শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরে আসার সময় বেআইনিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সাহসিকা শেখ হাসিনা সরকারি নিষেধাজ্ঞা, ষড়যন্ত্র ও মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ২০০৭ সালের ৭ মে ফিরে আসেন প্রিয় স্বদেশ ভূমিতে। কিন্তু এর মাত্র দুই মাস পর ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই নিজ বাসভবন সুধা সদন থেকে শেখ হাসিনাকে দানবীয় কায়দায় গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় একটি অস্থায়ী কারাগারে তাকে বন্দি করে রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একের পর এক ষড়ন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা। কারাগারে তার জীবননাশের ষড়যন্ত্র চলে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। জীবন-মৃত্যুকে পরোয়া না করে চলতে থাকে তার গণসংগ্রাম ও আইনি লড়াই। আওয়াজ ওঠে শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন নয়। বদলে যায় দৃশ্যপট। শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর শেরাটনের উইন্টার গার্ডেনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার ‘দিনবদলের সনদ: রূপকল্প-২০২১’ উপস্থাপন করেন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অর্জিত হয় ঐতিহাসিক বিজয়। এককভাবে আওয়ামী লীগই লাভ করে তিন চতুর্থাংশের বেশি আসন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। গঠিত হয় মহাজোট সরকার। শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও অমিত সম্ভাবনার শক্তিশালী ভীত রচিত হওয়ায় জনপ্রিয়তার অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যান শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আজ সফলতার সঙ্গে টানা তৃতীয় মেয়াদের পাশাপাশি চতুর্থবারের মতো দেশ পরিচালনা করছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সুফল পাচ্ছে আজ দেশবাসী। অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সব প্রতিবন্ধকতা সমস্যা-সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। ২০০৯ থেকে বিগত এক দশকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের বিনির্মাণের অভিযাত্রায় যুক্ত হয়েছে অজস্র সাফল্য-স্মারক। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দিনবদলের অভিযাত্রায় সব সঙ্কট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। অর্থনীতির সব সূচকেই অগ্রসর হতে শুরু করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত অধিকাংশ আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি বিশ্বখ্যাত ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক ২০০৯’ এ ভূষিত হন। ২০১০ সালের ২৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে আন্তর্জাতিক উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য সেন্টপিটার্সবাগ বিশ্ববিদ্যালয় ‘অনারারি ডক্টরেট’ প্রদান করে। শিশু মৃত্যু হ্রাস সংক্রান্ত এমডিজি-৪ অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ কর্তৃক এমডিজি অ্যাওয়ার্ড-২০১০ পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ২০১১ সালে প্যারিসের ডাউফিন ইউনিভার্সিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মর্যাদাপূর্ণ স্বর্ণপদক ও ডিপ্লোমা পুরস্কার প্রদান করে। আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন, সাউথ-সাউথ নিউজ ও জাতিসংঘের আফ্রিকা সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কমিশনের দেয়া ‘South South Awards 2011: Digital Development for Digital Health’ শীর্ষক পদক লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের হাউস অব কমনসের স্পিকার John Bercow, MP প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দূরদর্শী নেতৃত্ব, সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা, আঞ্চলিক শান্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে তার অনবদ্য অবদানের জন্য ‘Global Diversity Award’ প্রদান করেন। ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ‘ডি-লিট’ ডিগ্রি প্রদান করে ত্রিপুরা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি। শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনা, নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি এবং শান্তি ও গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের স্বীকৃতিস্বরূপ এই ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত মামলায় আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ইটলসের রায়ে বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেস্কো কর্তৃক ‘কালচারাল ডাইভারসিটি পদক’ লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থনে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ এবং ‘শান্তির সংস্কৃতি’ প্রস্তাব পাস হয়।
২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালের ১৬ জুন জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) দারিদ্র্য, অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করায় বাংলাদেশকে ‘ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড’ পদকে ভূষিত করে। ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর সাউথ সাউথ কো-অপারেশনের ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড-২০১৩’ পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার স্বপ্ন-প্রসূত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত তথ্যপ্রযুক্তি মেলায় সাউথ এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক Manthan Award পদকে ভূষিত হয়।
রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও অমিত সম্ভাবনার শক্তিশালী ভীত রচিত হওয়ায় জনপ্রিয়তার অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যান তিনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। এ সময় ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নারী ও কন্যাশিশুদের সাক্ষরতা ও শিক্ষা প্রসারে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘শান্তির বৃক্ষ’ (ট্রি অব পিস) পুরস্কার তুলে দেন ইউনেস্কোর মহাপরিচালক।
২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর জাতিসংঘের সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন ‘ভিশনারি’ পুরস্কার পান তিনি। ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনীতিতে নারী-পুরুষ বৈষম্য কমাতে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ‘উইমেন ইন পার্লামেন্ট (ডব্লিউআইপি) গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড’ পায় বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগতির স্বীকৃতি হিসেবে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সংস্থার (আইটিইউ) ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’ গ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার প্রদান করে জাতিসংঘ।
২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনা সভাপতি হন। ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসের জরিপে বিশ্বের ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৩০তম ক্ষমতাধর নারী হিসেবে অভিহিত করা হয়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে পিপলস অ্যান্ড পলিটিকসের গবেষণা প্রতিবেদনে সৎ সরকারপ্রধান হিসেবে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করে বাংলাদেশ। নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ‘গ্লোবাল সামিট অন উইমেন’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘গ্লোবাল লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। ২০১৮ সালের ২৬ মে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৯তম জন্মজয়ন্তীতে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের ‘কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লিটারেচার (ডি-লিট)’ প্রদান করে। গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন থেকে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ সম্মাননা প্রদান করে ‘কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়’। ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শান্তি সহযোগিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ‘ড. কালাম স্মৃতি পদক-২০১৯’ লাভ করেন তিনি। দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও ধারাবাহিকতা ধরে রেখে টিকাদানের মাধ্যমে শিশুরোগ নির্মূলে সফলতার জন্য গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন ও উমুনাইজেশন (জিএভিআই) কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং গত ২৬ সেপ্টেম্বর তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ’ পুরস্কার প্রদান করে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)।
করোনা মহামারির মহাসঙ্কটকালে বিশ্ব অর্থনীতি যখন স্থিমিত তখন শেখ হাসিনা জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করে দেশকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তা বিশ্বে অনুকরণীয়। শিল্প-কারখানা ও গার্মেন্টসহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন সেক্টরে তার সাহসী সিদ্ধান্ত দেশকে স্বল্প উন্নত থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে সাহায্য করেছে। যা ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভ্যাকসিন সংগ্রহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলিসি এবং দক্ষতা সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত হয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে বিগত এক দশকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের বিনির্মাণের অভিযাত্রায় যুক্ত হয়েছে অজস্র সাফল্য-স্মারক। বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি ও সমুদ্রবক্ষে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্লু ইকোনমির নতুন দিগন্ত উন্মোচন, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয়, সাবমেরিন যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো চার-লেনে উন্নীত করা, এলএনজি টার্মিনাল, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ ডলার, প্রবৃদ্ধি ৮.১ শতাংশ, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাওয়া, ৯৪ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা, সাক্ষরতার হার ৭৩.৯ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিনে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেয়া, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতি দান, মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রত্যেকটি জেলায় একটি করে সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারীনীতি প্রণয়ন, সোনালি আঁশ পাটের জিন প্রযুক্তির আবিষ্কার, নতুন বর্ধিত বেতন-স্কেল কার্যকর করা, গার্মেন্ট শ্রমিকদের পে-স্কেল পুনর্নির্র্ধারণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ফোর-জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে কালউত্তীর্ণ সাফল্য অর্জন করেছেন শেখ হাসিনা। মিয়ানমারের নির্যাতিত ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে মাদার অব হিউমেনিটি খেতাব অর্জন করেছেন তিনি। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে সারা দেশে ভূমিহীন মানুষকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে সাড়ে আট লাখ ঘর উপহার দেয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা যেমন একজন সফল রাজনীতিক তেমনি তার আরেকটি পরিচয় হলো একজন ভালো লেখক। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ‘ওরা টোকাই কেন?’, ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’, ‘দারিদ্র্য বিমোচন, কিছু ভাবনা’, ‘আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম’, ‘আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি’, ‘সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র’, ‘সাদা কালো’, ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’, ‘Miles to Go, The Quest for Vision-2021 (two volumes)’। তিনি ‘জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর সভাপতি। শেখ হাসিনার জ্যেষ্ঠ পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশারদ। তার একমাত্র কন্যা সায়মা হোসেন ওয়াজেদ একজন মনোবিজ্ঞানী এবং তিনি অটিস্টিক শিশুদের কল্যাণে কাজ করছেন। ২০০৯ সালের ৯ মে তার স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া মৃত্যুবরণ করেন। শেখ হাসিনার নাতি-নাতনির সংখ্যা ৭।
সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে দুর্যোগের সঙ্কটপূর্ণ সময়ে সমাধানের সূত্র তুলে ধরেছেন। যুদ্ধ, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, ক্ষমতার প্রভাব এবং স্বার্থগত সংঘাতকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবমুক্তির প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি জবরদস্তিমূলক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মতো বৈরীপন্থা পরিহার করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট ও বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে
|