কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর গতকাল সোমবার ফের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় তাঁদের মারধর করা হয়। এতে চার-পাঁচজন আহত হয়েছেন। এক নেতাকে তুলে নিয়ে যাওয়ারও অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারীরা। হামলার জন্য তারা এবারও দায়ী করছেন সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে। তবে সেখানে উপস্থিত ছাত্রলীগ কর্মীরা বলেছেন, সংগঠন থেকে নয়, সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেব তারা ‘শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ’ বজায় রাখতে কাজ করছেন। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেছেন, হামলা বা মারধরের বিষয়ে কেউ তাকে জানায়নি। অভিযোগ পেলে তারা ব্যবস্থা নেবেন। এর আগে গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে পিটুনির শিকার হন আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হাসান আল মামুন ও যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল হক নূর। ঢাকার পর চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের কর্মসূচিতে হামলা চালিয়ে মারধর করা হয়। গতকাল সোমবার সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিক্ষোভ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকার আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে ছাত্রলীগ কর্মীদের উপস্থিতি দেখে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে জড়ো হতে শুরু করেন। বেলা সোয়া ১১টার দিকে কয়েকজন আন্দোলনকারী শহীদ মিনার চত্বরে ব্যানার নিয়ে দাঁড়ালে একদল যুবক দৌড়ে এসে তাদের ওপর চড়াও হয় এবং বেধড়ক মারধর শুরু করে। হামলাকারীদের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরও দেখা যায়। হঠাৎ এই হামলার মুখে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। দুজনকে চত্বরে ফেলে এলোপাতাড়ি লাথি ঘুষি মারতে দেখা যায় এসময়। বিক্ষোভ মিছিলে আসা ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী লুৎফর রহমান লীমা সাংবাদিকদের বলেন, কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন ফেইক ফেসবুক আইডি থেকে আমাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। এখন প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বলছে, ছেলেদের গুম করা হবে আর মেয়েদের ধর্ষণ করা হবে। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমাদের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেনকে ফ্লোরের ওপর ফেলে বেধড়ক মেরেছে। আমাকেও তারা মেরেছে, আমি দৌড়ে পালিয়ে এসেছি। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ফারুককে একটি মোটর সাইকেলে করে তুলে নিয়ে গেছে বলেও অভিযোগ করেন মামুন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরা হামলাকারীদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা দাবি করেন তারা ‘এখানকার ছাত্র’। সেখানে উপস্থিত হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী বলেন, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে এখানে এসেছি। তারা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বাজে কথা বলেছে। তারা পরিকল্পনা করেছিল আজকের (সোমবারের) কর্মসূচিতে তারা লাঠিসোঁটা, রড নিয়ে অবস্থান করবে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছে। এরা আর কেউ না, এরা জামায়াত-শিবির। তাই আমরা এখানে এসেছি। আমরা ছাত্রলীগ না, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, শনিবার যে ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে আমি অবহিত হয়েছি। আমাদের প্রক্টরিয়াল টিম ও শিক্ষকরা যার যার অবস্থান থেকে কাজ করেছেন। তবে আজকের হামলা বা মারধোরের বিষয়ে আমাকে কেউ অবহিত করেনি। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ ব্যানারে কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করে আসছে একদল শিক্ষার্থী। তাদের আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী কোনো ধরনের কোটাই আর রাখা হবে না বলে জানালেও সরকারি প্রজ্ঞাপন না আসায় নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পূর্বঘোষিত সংবাদ সম্মেলনে বাধা দিয়ে ব্যাপক মারধর করা হয়। এতে ১০ জনের মতো আহত হন। আহতরা অভিযোগ করেছেন, হামলাকারীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। তবে হামলা ও মারধরের ব্যাপারে ছাত্রলীগের নেতাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এর পরই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ অধিকার ছাত্র সংরক্ষণ পরিষদের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে বাধা ও হামলার প্রতিবাদে গত রোববার থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে গত রোববার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের মানববন্ধনের কর্মসূচি চলাকালে হামলার ঘটনা ঘটে। কিন্তু গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস থাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি পালিত হয়নি। গতকাল সোমবার কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতির সময় ফের হামলা ও মারধরের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার পর থেকে আন্দোলনকারীরা শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকেন। ১০টা ২০ মিনিটের দিকে ৩০-৪০ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী সেখানে আসেন। এর মধ্যে ছিলেন মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান সানি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক সাঈদ বাবু, বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আলামিন রহমান, বিজয় ৭১ হলের সভাপতি ফকির আহমেদ রাসেল, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি মেহেদি হাসান রনি প্রমুখ। এ সময় আন্দোলনকারীরা ব্যানার নিয়ে মানববন্ধনে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার আগেই আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। তখন আন্দোলনকারীদের আহ্বায়ক রাশেদ আল মামুন সেখান থেকে সরে যান। যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেনসহ দুজনকে সেখানে ফেলে মারধর করা হয়। এতে চার-পাঁচজন আহত হন। তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আন্দোলনকারীদের যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুন নাহার নীলা শহীদ মিনারে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ফারুককে ছাত্রলীগ নেতা আলামিন রহমানের একটি মোটরসাইকেলে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আমরা জানি না। এ ঘটনার পর সেখানে থাকা ১৫-২০ জন আন্দোলনকারী শহীদ মিনারে ব্যানার নিয়ে মানববন্ধনে দাঁড়ান। তখন সাঈদ বাবুর নেতৃত্বে ফের হামলা চালানো হয়ে বলে অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা। পরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের শহীদ মিনার থেকে চলে যেতে বলেন। আন্দোলনকারীদের যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুন নাহার নীলা বলেন, আমরা যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করছি। সেখানে হামলা করা হয়েছে। আমরা কি আমাদের কথা বলতে পারব না? প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন দিয়ে দিলে আমরা আর আন্দোলন করব না। আমরা প্রজ্ঞাপন চাই। এ বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ এপ্রিল সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করেন আন্দোলনকারীরা। পরে প্রধানমন্ত্রী সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারীরা এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আনন্দ মিছিলও করে। কিন্তু সেই প্রজ্ঞাপন এখনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি।