নগদ অর্থের সঙ্কটে কমে গেছে অধিকাংশ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ
তারিথ
: ০২-০৭-২০১৯
অনলাইন ডেস্ক :
তারল্য সঙ্কটে ভুগছে দেশের ব্যাংকিং খাত। দুই বছর আগেও ব্যাংকগুলোর কাছে অলস অর্থ ছিল দেড় লাখ কোটি টাকা। এখন তা নেমে এসেছে ৬৩ হাজার কোটি টাকায়। সেগুলো আবার বিভিন্ন বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ হিসেবে রয়েছে। অধিকাংশ ব্যাংকের হাতে তাৎক্ষণিকভাবে দেয়ার মতো নগদ অর্থ নেই। সেজন্য অধিকাংশ ব্যাংকেরই ঋণ বিতরণ কমে গেছে। মূলত চাহিদা অনুযায়ী আমানত সংগ্রহ করতে না পারার কারণেই বেশিরভাগ ব্যাংকে নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সঙ্কট মোকাবেলায় অনেক ব্যাংক ১০ শতাংশের বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করতে চাইলেও গ্রাহকদের থেকে সাড়া মিলছে না। ফলে ব্যাংকের সুদের হার ১৬-১৭ শতাংশে পৌঁছে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, খেলাপী ঋণ বেড়ে যাওয়া ও চাহিদামতো ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ করতে না পারায় ব্যাংক খাতে তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শিল্প ও বাণিজ্য খাতে ঋণের চাহিদা বাড়লেও তারল্য সঙ্কটে অর্থ দিতে পারছে না ব্যাংক। এ সঙ্কট সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে আমানত বাড়ানো। কিন্তু ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে প্রায় সব ব্যাংকই এখন নতুন নতুন স্কিম চালু করছে। চলতি বছরের মার্চে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২৩ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। আগের বছরের মার্চে যা ছিল ৯ লাখ ২৫ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে মাত্র ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অথচ বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। আমানত সংগ্রহ তুলনামূলক কম হওয়ায় ব্যাংকের তারল্য ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ কমে গেছে। চলতি বছরের মার্চে তরল সম্পদ (লিকুইড এ্যাসেট) দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। গত বছরের মার্চে যা ছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। এক বছরে তারল্য কমেছে ১৬ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। ব্যাংকিং পদ্ধতি অনুসারে ঋণের টাকা নগদ হিসেবে গ্রাহকের হাতে তুলে দেয়া হয় না। একাউন্টে প্রদান করা হয়। অর্থাৎ যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়, ওই পরিমাণ অর্থ আমানত হিসেবে যোগ হয়। আবার ব্যাংকগুলো নতুন নতুন গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে। ফলে স্বাভাবিকভাবে ঋণের তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধি বেশি থাকার কথা। কিন্তু এখন উল্টো ঘটছে। ঋণের তুলনায় আমানত কম বাড়ছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে নতুন আমানত সংগ্রহ আনতে পারছে না। সূত্র জানায়, ব্যাংকিং খাতের তারল্য সঙ্কটের প্রধান কারণ ব্যাংকের ওপর লোকজনের আস্থাহীনতা। তাই ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি প্রতি মাসে কমে যাচ্ছে। তাছাড়া সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ও ব্যাংকের সুদে পার্থক্য এবং নানা কেলেঙ্কারির কারণে ডিপোজিট (আমানত) কমে যাচ্ছে। আর ডিপোজিট কমলে তারল্য সঙ্কট দেখা দেয়া স্বাভাবিক। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ উদ্ধার করতে হবে। তাতে করে মানুষের আস্থা ফিরবে এবং আমানত সংগ্রহ বাড়বে। তা না করতে পারলে কোন লাভ হবে না। বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়তো সম্ভব হবে না। তবে বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রির যে লক্ষ্যমাত্রা থাকে, তা পূরণ হলে বিক্রি বন্ধ করে দিলে পরিস্থিতির বদল ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, চলতি বছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত জনসাধারণ ৬৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছে। আর ওই সময়ে ব্যাংক জমা রেখেছে ৫৫ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখার পরিমাণ ১৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা বেশি। গত বছরের জুলাইয়ে ব্যাংকগুলোয় আমানত ছিল ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ১০ লাখ ২৩ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় সব ব্যাংকই অর্থ সঙ্কটে পড়েছে। এর কারণ মূলত দুটি। সরকারের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। ব্যাংকগুলো ওই কাজে অর্থায়ন করছে। এদিকে ব্যাংকিং খাতের তারল্য সঙ্কট প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংকগুলো আমানতের তুলনায় বেশি ঋণ দিয়ে তা আদায় করতে পারছে না। তাতেই ব্যাংক খাতে তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনার কারণে সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলছে। অনেক গ্রাহক এখন ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহ পান না। আবার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি থাকায় মানুষ সঞ্চয়পত্র কেনার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ফলে ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না। অন্যদিকে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, ব্যাংক খাতে তারল্য সঙ্কট রয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের টাকা আটকে গেছে। খেলাপি ঋণ উদ্ধার না হওয়া একটা বড় সমস্যা। তাছাড়া খেলাপিদের নানা সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব ব্যাংক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আমানতের ওপর নির্ভরশীল। এটার পাশাপাশি বন্ড মার্কেট, ক্যাপিটাল মার্কেটও দরকার। তাছাড়া ব্যাংকগুলোকে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে। এসব কারণে নানা ঝামেলা হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে বন্ড মার্কেট তৈরি করতে হবে। তখন দীর্ঘ মেয়াদে থাকা ঋণ বন্ড বিক্রির মাধ্যমে রিপ্লেস করতে হবে।