মুহা.ফখরুদ্দীন ইমন :
বাংলা পৃথিবীর সুপ্রাচীন সমৃদ্ধ এক ভাষা। এ ভাষার রয়েছে অনেক মূল্যবান ঐতিহ্য ও নিদর্শন। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, মরমী সাধক লালন শাহ্, বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্যাচার্য্য, মহিয়সি নারী বেগম রোকেয়া, জীবনানন্দ দাস, পল্লী কবি জসিম উদ্দীন সহ অসংখ্য মনিষীর স্পর্শে সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভান্ডার। “হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন,তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি, পর ধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি”। বঙ্গপোসাগরের তীর ঘেষে সবুজ বদ্বীপ অঞ্চল জুড়ে অপরূপ সৌন্দর্য্যরে এক দেশ বাংলাদেশ। আবহমান কাল থেকে এ মাটির মানুষ নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বদা সোচ্চার। তারা বিদেশি শাসন-শোষনে নির্যাতিত হয়েছে বারবার। কিন্তু মাথা নত করেনি কোনদিন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও বাঙ্গালী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকেই যায়। প্রথম আঘাতটি আসে ভাষার উপর। ভাষাবিদ ড. মো.শহিদুল্লাহ্ বললেন, বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ত্রিপুরা তথা কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত তৎকালীন গণ পরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রস্তাব দিলেন, বাংলাকে গণ পরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হোক। কিন্তু এক্ষেত্রে বাঙ্গালীর সব যৌক্তিক দাবী অগ্রাহ্য হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, সারাদেশে পালিত হলো প্রথম মাতৃভাষা দিবস। বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে পূর্ব বাংলার তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন বাংলাকে অন্যতম রাষ।ট্র ভাষা হিসেবে মেনে নেবার অঙ্গিকার করলেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ, পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকা রেইসকোর্স ময়দানে এবং তিন দিন পর ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের কার্জন হলে ঘোষনা দিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। পাকিস্তানিরা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলো বাঙ্গালীকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে না। আরবী হরফে বাংলা প্রচলনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে খাজা নাজিম উদ্দীন সাহেব ঢাকায় এসে দম্ভের সাথে ঘোষনা দিলেন, একমাত্র উর্দুই হবে দেশের রাষ্ট্র ভাষা। ৩১ জানুয়ারী প্রতিবাদি ছাত্র নেতারা সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে দীর্ঘ কর্মসূচি ঘোষনা করেন। ২০ ফেব্রুয়ারী থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। স্বৈরশাসকের আইন অমান্য করে ২১ ফেব্রুয়ারী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় জড়ো হন। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই দাবিতে তারা খন্ড খন্ড দলে মিছিল করে নিয়ে আসেন রাজ পথে। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য মন্ত্রী নুরুল আমিনের নির্দেশে ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালানো হয়। নিহত হন আব্দুল জব্বার, রফিক উদ্দীন আহমেদ, আব্দুস সালাম, শফিউর রহমান আবুল বরকত। এই আন্দোলনকে সমর্থন করে কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী টানা বার দিন অনশন করেন। অমর একুশের স্মৃতির স্বারক আমাদের শহীদ মিনার। এই মিনারের সাথে মিশে আছে বাঙ্গালীর অনেক রক্ত ও অশ্রুজল। মিশে আছে তারুন্যের গৌরব গাঁথা। শহীদ মিনার যেন এক অশ্রুসজল গরবিনি মায়ের প্রতীক। মা যেন তার সাহসী সন্তানদের গর্বে গর্বিত, শ্রদ্ধা অবনত। ১৯৫২ সালের একুশ ফেব্রুয়ারী নিহত ছাত্রদের স্মরণে নির্মিত দেশের প্রথম শহীদ মিনার তৎকালীন স্বৈরশাসকের নির্দেশে ২৩ ফেব্রুয়ারী ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হয়। অমর একুশের চেতনা থেকেই বাঙ্গালী তার অধিকার সম্পর্কে আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করে। কিছু তরুন প্রাণ এগিয়ে এসেছিলো উদ্দীপ্ত শ্লোগানে। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। কিছু উদ্ধত বুলেটের হুঙ্কারে সে শ্লোগান থামেনি। বুলেটের চেয়েও বেশী শক্তিশালী ছিলো সেই শ্লোগান। যে শ্লোগান সুনামীর মত ছড়িয়ে পড়লো দেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে। ভাষার শ্লোগান থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাড়িয়ে গেল বাংলাদেশ। বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই হলো নতুন একটি পতাকার। আমাদের একুশ পেলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। সাহিত্যে নোবেল, সিনেমায় অস্কার, আন্তর্জাতিক ফোরামে, অনলাইনে-অফলাইনে কিংবা আফ্রিকার সিয়েরা লিয়নে বাংলা এগিয়েছে অনেক। ভিন্ন্ সময়ে ভিন্ন শ্লোগানে বাংলা পৌঁছে গেছে সবখানে। এবার সময়, জাগো বাঙ্গালী নতুন শ্লোগানে। দাবি একটাই, জাতি সংঘে বাংলা চাই, জাতি সংঘে বাংলা চাই। আমাদের সকলের দাবি, জাতি সংঘের সপ্তম দাপ্তরিক ভাষা হবে বাংলা। আপনিও যোগ দিন নতুন এই শ্লোগানে। আমাদের ভাষা আমাদের গর্ব, আমাদের শেকড়। এ শেকড় রক্তে ¯œাত, চেতনার গভীর গহীনে গ্রথিত। তাই একে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আসুন শুদ্ধ বাংলায় কথা বলি। শুদ্ধ বাংলা ভাষাকে চর্চা করি। অন্যকে বাংলায় কথা বলতে উৎসাহিত করি এবং ভাষাকে ভালোবাসি।
|