তানিয়া আহম্মেদ : মানুষ কেন কেন এই বিষণ্নতায় ভোগে এর কোনো সহজ উত্তর নেই। নানা কারণেই কেন এই বিষণ্নতা গ্রাস করতে পারে মনকে। সাধারণভাবে মানসিক চাপ থেকে কেন এই বিষণ্নতায় ভোগে মানুষ। হয়ে পড়ে অবসাদগ্রস্ত। মানসিক সেই চাপ থেকে ভয়াবহ মানসিক রোগে আক্রান্ত হন অনেকেই। তবে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী জিন এম টোয়েঙ্গি বলছেন, অতি স্বাধীনতা, পরিবার বিচ্ছিন্নতা মানুষকে কেন এই বিষণ্নতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যে কোনো সমস্যায় আগে যেমন মানুষ পরিবারের মা-বাবা, দাদা-দাদী, বড় ভাই-বোনদের সঙ্গে আলোচনা করতো এখন সে সুযোগ যেমন কমেছে, তেমনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ তীব্র হয়ে ওঠায় কেউ নিজের কথা অন্যকে বলতে চাইছে না। মানুষের সামাজিক এই বদলে যাওয়া আচরণও কেন এই বিষণ্নতাকে বাড়িয়ে তুলছে। আধুনিক বিশ্বে যেদিকেই তাকাই জীবনের ভারে কেন এই বিষণ্ন অবসন্ন মানুষ দেখি। সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। আরো চাই, কী কী পেলাম না এসব নিয়ে ভাবনা। চাকরি, ব্যবসা, নানা উত্তেজনায় মানুষের ঘুম কমে গেছে, স্মরণশক্তি কমে গেছে। চিন্তার ক্ষমতাও কমে গেছে। মার্কিন সমাজবিদ জিন এম টোয়েঙ্গি তার অপর এক গবেষণায় দুশ্চিন্তা ও কেন এই বিষণ্নতা নিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের ৭০ লাখ মানুষের ওপরে গবেষণা চালিয়েছেন। সেখানে দেখা গেছে ১৯৮০ সালের তুলনায় ২০১০ সালে ৩৮ শতাংশ মানুষের স্মরণশক্তি কমে গেছে। আর ৭৪ শতাংশ মানুষের রাতে ঘুম আসে না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ ছাত্র বলছে পড়াশোনা তাদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এই চাপ নিতে পারছে না। এই সবকিছুর মূলে দুশ্চিন্তা ও কেন এই বিষণ্নতা। বর্তমান বিশ্বে ডিজিজ বার্ডেন হিসেবে কেন এই বিষণ্নতার স্থান তৃতীয়। ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে কেন এই বিষণ্নতা বিশ্বে ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৩০ সালে কেন এই বিষণ্নতা ডিজিজ বার্ডেন’ তালিকায় প্রথম স্থানে অবস্থান করবে। যে কোনো বয়সে এমনকি শিশুরাও বিষণœতায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে কেন এই বিষণ্নতা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। দীর্ঘ মেয়াদী শারীরিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কেন এই বিষণ্নতার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মোহিত কামাল বললেন, জীবন যন্ত্রণা থেকে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে কেন এই বিষণ্নতায়। তার আবেগে ধস নামলে জীবনকে শূন্য মনে হয়, আশাহীনতা গ্রাস করে। এই অবস্থা যদি কোনো ব্যক্তির ১৪ দিন চলতে থাকে তবে তাকে কেন এই বিষণ্নতায় আক্রান্ত বলবো। এই অবস্থা আরো ভয়াবহ বলে সেই ব্যক্তি আত্মহত্যার কথা ভাবতে থাকে। মানসিক রোগের মাত্রা আরো বেশি হলে তিনি আত্মহত্যা করেন। এই অবস্থায় পরিবার, বন্ধুদের এগিয়ে আসতে হবে। কেন এই বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে দাঁড়াতে হবে। বিষণœ ৩০ কোটি মানুষ: বর্তমানে সারাবিশ্বে ৩০ কোটি মানুষ কেন এই বিষণ্নতায় ভুগছে। সে হিসেবে প্রায় প্রতি ২৫ জনের মধ্যে একজন বিষণœতায় আক্রান্ত। দেশ ভেদে শতকরা তিন থেকে ১৭ শতাংশ মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময় কেন এই বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। ১৫ থেকে ১৮ বছর ও ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে কেন এই বিষণ্নতার ঝুঁকি বেশি। আর ১৫ থেকে ৩০ বছরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে প্রতিদিন তিন হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। এ হিসেবে বছরে আত্মহত্যার সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখ। এরমধ্যে বেশিরভাগ আত্মহত্যাই ঘটে কেন এই বিষণ্নতাজনিত কারণে। পেশাগত জটিলতা, পারিবারিক জটিলতা- এসব মানুষের জন্য নতুন কোনো সমস্যা নয়। সবকালে সবসময় এই সমস্যা ছিল। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা, পরশ্রীকাতরতা, সামাজিক অন্যায়, অফিস পলিটিক্স- এসব মানুষকে অস্থির, হতোদ্যম, কখনো কখনো অসহায় করে তোলে। এই ধরনের বাজে পরিস্থিতি থেকে একজন ব্যক্তির মুক্তির উপায় ছিল তার পরিবার। এখন সেই পরিবারপ্রথা ভেঙে যাওয়ায় মানুষ তার অসহায় মুহূর্তে আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে না। মার্কিন সমাজবিদ জিন টোয়েঙ্গি তার গবেষণায় আরো বলছেন, আধুনিক জীবন ব্যবস্থা মানুষের মানসিক প্রশান্তির অন্তরায়। যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারে আসায় মানুষের ভাবনার আদান-প্রদান যেমন কমছে তেমনি বিভিন্ন সমস্যার কথা কাউকে বলবার মানুষও কমেছে। এই একাকীত্ব আর ভাবনার আদান-প্রদান করতে না পারার কারণে কেন এই বিষণ্ন মন কেন এই বিষণ্নতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেশেও কেন এই বিষণ্নতার চিত্র ভয়াবহ: বাংলাদেশের শহরের সমাজ ব্যবস্থা ও পরিবার কাঠামোও আধুনিক বিশ্বের চাইতে খুব বেশি আলাদা নয়। এখানেও যৌথ পারিবারিক কাঠামো ভেঙে একক পরিবারের মাঝেই এখন মানুষ স্বস্তি খুঁজছে, স্বাধীনতা খুঁজছে। কিন্তু সত্যিই কী মিলছে স্বস্তি, স্বাধীনতা। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ মানসিক চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট পরিচালিত জরিপ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৭৪ লাখ নারী-পুরুষ কেন এই বিষণ্নতায় ভুগছে, যা মোট জনসংখ্যার ৪.৬ শতাংশ। স্থানীয় জরিপে দেখা গেছে, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে মোট মানসিক রোগী ১৬.১ শতাংশ, উদ্বেগাধিক্য ৮.৪ শতাংশ, কেন এই বিষণ্নতা ৪.৬ শতাংশ, গুরুতর মানসিক রোগ ১.১ শতাংশ, মাদকাসক্ত ০.৬ শতাংশ। কেন এই বিষণ্নতা নানা মাত্রায় হতে পারে। এটি হতে পারে তীব্র অথবা দীর্ঘমেয়াদী। মানসিক কেন এই বিষণ্নতা বাংলাদেশে খুবই সাধারণ। ঢাকার নিকটবর্তী একটি গ্রামে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার প্রায় ২.৯ শতাংশ লোক কেন এই বিষণ্নতায় ভুগছে। আরেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীর এক হাসপাতালে মনোরোগ বহির্বিভাগে আগত রোগীদের এক তৃতীয়াংশ রোগীই সাধারণভাবে কেন এই বিষণ্নতার শিকার। কেন এই বিষণ্নতার উপসর্গ:কেন এই বিষণ্নতা একজন ব্যক্তির জীবনের যে কোনো একটি অথবা সবকটি ক্ষেত্রকেই প্রভাবিত করে। মারাত্মক অবস্থা, উপসর্গ, কারণ এবং চিকিত্সা অনুসারে এই রোগের ভিন্নতা দেখা যায়। কেন এই বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তি শুধুমাত্র আবেগসংশ্লিষ্ট মানসিক অশান্তিতেই ভোগে না বরং উদ্বুদ্ধকরণ, চিন্তা-ভাবনা, শারীরিক এবং সাধারণ চলাফেরাতেও তা প্রকাশ পায়। একজন কেন এই বিষণ্নতায় আক্রান্ত মানুষ এক বা একাধিক উপসর্গে ভুগতে পারে। এগুলো হলো- বিষাদময় অনুভূতি, হতাশা বা সবকিছু অর্থহীন ভাবা, অপরাধবোধ, দৈনন্দিন কাজকর্মে আগ্রহ বা আনন্দ হারিয়ে ফেলা, ক্ষুধামন্দা, ওজন কমে যাওয়া, নিদ্রাহীনতা, চলার গতি ধীর হয়ে যাওয়া বা অস্থিরতা, শক্তি এবং উদ্যম কমে যাওয়া, ধীর গতিতে চিন্তা করা বা প্রতিক্রিয়া দেখানো এবং মৃত্যুচিন্তা বা আত্মহত্যার প্রবণতা। পশ্চিমা দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কেন এই বিষণ্নতার উপসর্গসমূহ কিছুটা পৃথক। এগুলো সচরাচর বিষাদময় অনুভূতি এবং অপরাধ বোধের চেয়ে শারীরিক অভিযোগের আকারে বেশি প্রকাশিত হয়। যেমন- কোনো কিছু চেপে বসা, মাথায় তাপ এবং মাথা ব্যথা, দ্রুত হূদস্পন্দন, ঘুমের ব্যাঘাত, যৌন ইচ্ছা বা ক্ষমতা কমে যাওয়া, আন্ত্রিক গোলযোগ ইত্যাদি। কেন এই বিষণ্নতা থেকে মুক্তির উপায়:মনোবিশেষজ্ঞ ড. মোহিত কামাল জানান, কেন এই বিষণ্নতা প্রতিরোধ করতে হলে নজর দিতে হবে কেন এই বিষণ্নতা কেন হয় সে কারণগুলোর দিকে। কেন এই বিষণ্নতা আমাদের শক্তি, প্রত্যাশা ধ্বংস করে দেয়। তাই কেন এই বিষণ্নতা মোকাবিলা করতে বেশ কিছু কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে জীবনযাত্রায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়। যেমন, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়া, ভালো বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে যাওয়া, তাদের সঙ্গে সময় কাটানো। বিশেষ করে যারা জীবনকে ইতিবাচকভাবে দেখেন তাদের সঙ্গে কথা বলা, প্রতিদিন ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমানো এবং কিছু সময়ের জন্য রোদে ঘোরাফেরা করা। নিয়ম করে তিনবেলা খাওয়া-দাওয়া করা। সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করা। প্রতিটি মানুষের জীবনে মানসিক চাপ আসে। সে জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা এবং চাপ মোকাবিলা করা শেখা। প্রতিদিনের কাজের তালিকায় নিজের আনন্দের জন্য অন্তত খেলাধুলা, বই পড়া ভাল। এ ছাড়া নিজের মনোকষ্টের কথাগুলো অপরজনের কাছে খুলে বলা, যিনি বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, বুঝবেন এবং অন্যদের কাছে গোপন রাখবেন। নিজের ভুল বা নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে চিহ্নিত করতে শেখা ও এগুলোকে ইতিবাচক চিন্তায় রূপান্তর করা।
|