সোহেল টিটু,মুন্সীগঞ্জ থেকে :
শষ্যশ্যামল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মুন্সীগঞ্জের রাজাবাড়ী দিঘীরপাড়ের পদ্মাচর।চারোদিক সবুজায়নে ঘেরা।সরিষা ফুলে মধু আহরণে মৌমাছিদের গুঞ্জন।কাশবনে বাবুই চড়াই পাখিদের কিচিরমিচির গান। দোয়েল ফিঙ্গে শালিক আর সাদা বলাকাদের দল বেঁধে উড়ে চলা।বিদেশি পাখিদের ঝিলের জলে ডুবডুবি খেলা।মাছরাঙ্গা পাখির মাছ শিকারের দৃশ্য।শেষ বিকেলে নদীর জলে সোনালী রবির অবগাহন,আহা! কি অপরূপ নান্দনিক মহিমাময় সৌন্দর্যে সৃষ্টি করেছেন বিধাতা এই পদ্মাচর। পদ্মাচরে পদ্মার শাখা নদীতে পরিবার পরিজন আর প্রিয়জনকে নিয়ে নৌভ্রমণের মজাই এক অন্যরকম আনন্দ।শহরের কোলাহলময় ক্লান্তিকর জীবন থেকে হাঁফ ছেড়ে নিশ্বাস নিতে,সবুজ প্রাকৃতির সতেজ অক্সিজেন গ্রহণ করতে, নিজের আত্মাকে একটু স¦স্তি দিতে,বাংলার ভ’-সর্গীয় আশ্চর্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে আর এই নিসর্গীয় শ্যামলীমাময়ের সাথে নিজেকে ফ্রেমে বন্দি করে রাখতে দূরদূরান্ত হতে দৈনন্দিন দর্শনার্থীরা ছুটে আসছেন মুন্সীগঞ্জের এই পদ্মাচরে। সুবিশাল এই পদ্মাচরটি মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা ও টঙ্গীবাড়ী উপজেলার সর্বশেষ দক্ষিণে অবস্থিত। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বাংলাবাজার ও শিলই ইউনিয়ন এবং টঙ্গীবাড়ী উপজেলার দিঘীরপাড়,কামারখাড়া,ও হাসাইর-বানারী ইউনিয়ন নিয়ে পূর্বপশ্চিমে প্রায় ১০-১২ কিলো মিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই পদ্মাচরের।পদ্মাচরের দক্ষিণে মূল পদ্মানদী। আর এই পদ্মানদীর ওপাড়েই শরীয়তপুর জেলা অবস্থিত। এর মধ্যে অন্যতম হলো মোগল আমলে প্রতিষ্ঠিত রাজাবাড়ী দিঘীরপাড়।রাজাবাড়ী দিঘীরপাড় নামে এই এলাকাটি অত্যান্ত পুরানো ইতিহাস সমৃদ্ধশীল একটি এলাকা হিসেবে সুপরিচিত ছিলো। তৎকালীন মোগল আমলে বিক্রমপুরের শহর শ্রীপুরের নিকটেই অবস্থিত ছিলো রাজাবাড়ী দিঘীরপাড়। মোগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে আড়ফুল বাড়িয়া গ্রামের দুই সহদোর বাঙালী বিপ্লবী চাঁদ রায় ও কেদার রায় বিক্রমপুরের অন্তর্গত পদ্মা তীরবর্তী শ্রীপুর দুর্গ হতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।১৬০৩ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শ্রীপুরের সর্বশেষ রাজা কেদার রায় মোগলদের হাতে নিহত হন। আর তখন থেকেই বিলুপ্তি ঘটে বিক্রমপুরের স্বাধীনতা।বিট্রিশ সরকার ১৮৪৫ সালের মার্চ মাসে মুন্সীগঞ্জকে মহকুমায় উন্নীত করে সে সময় শ্রীপুরের হেডকোয়ার্টার ও থানা রাজাবাড়ী দিঘীরপাড়ে নামে ছিলো।অর্থাৎ মুন্সীগঞ্জ, শ্রীনগর,রাজাবাড়ী ও মূলফতগঞ্জে হলো সাবডিভিশন মুন্সীগঞ্জ।রেনেল কর্তৃক অঙ্কিত বিক্রমপুর মানচিত্রে সিরাজাবাদের ঠিক দক্ষিণেই ছিলো রাজাবাড়ী।জিরামপুর,হাতামারী,কার্তিকপুর,সিরাজাবাদ,সরিষাবন,স্বর্ণগ্রাম,কবুতরখোলা,কেদারপুর,(শরীয়তপুর) ডাইনলাঙ্গা,জয়পুর দ্বীপ গুলো নিয়ে রাজাবাড়ী অবস্থিত ছিলো। ১৮৬৯ সালের কোন এক সময় শ্রীপুর শহর ও রাজাবাড়ী পদ্মানদীর কবলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ।ফলে দ্বিতীয়বার পুনরায় রাজাবাড়ী দিঘীরপাড় কিছুটা উত্তরে এগিয়ে এসে সমৃদ্ধশালী রাজাবাড়ী দিঘীরপাড় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালে রাজাবাড়ী দিঘীরপাড় নদী গর্ভে বিলিন হযে যায় । ১৯৯৩-৯৪ দিকে তৃতীয়বারের মত আবার কিছুটা উত্তরে এসে বর্তমান দিঘীরপাড় গড়ে উঠে।তবে কালের বিবর্তনে রাজাবাড়ী নাম ও ঐতিহ্যের বিলপ্তি ঘটে। বর্তমানে যে পদ্মাচরটি জেগে উঠেছে এটিই মূলত আসল রাজাবাড়ী দিঘীরপাড়। আর এই বর্তমান পদ্মাচরটি সৃষ্টিকর্তা এক অপরূপ নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।নিঃসন্দেহে মুন্সীগঞ্জের এই পদ্মাচরটি একটি দর্শনীয় স্থান। সুদূর ঢাকা থেকে আগত দর্শনার্থী মোঃ জহির ইসলাম-এর কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন,সত্যিই এই পদ্মাচরটি একটি দর্শনীয় স্থান।সবুজ প্রকৃতি আর পদ্মার সতেজ হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়।শহরের শত ব্যস্থতার মাঝে যখনি একটু সময় পাই তখনি চলে আসি এই পদ্মাচরে। প্রকৃতির সবুজায়ন এ যেনো এক ভূ-সর্গ।প্রকৃতির নির্মল সতেজ হাওয়ার স্পর্শ পেলে শরীর ও মন ভালো হয়ে যায়।ইতিহাস সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যবাহী রাজাবাড়ী নামটি ধীরেধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে।শোনেছি রাজাবাড়ী দিঘীরপাড়ে ”রাজাবাড়ীর মঠ” নামে একটি সুউচ্চ মঠ ছিলো। এই ইতিহাস ঐতিহ্যবাহী রাজাবাড়ী দিঘীরপাড়ের শেষ চিহ্ন টুকু বাঁচিয়ে রাখা একান্ত জরুরী।এই দর্শনীয় স্থানটি রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন।কর্তৃপক্ষ যদি এই রাজাবাড়ী দিঘীরপাড় পদ্মাচরটির দিকে একটু নজর দেন,তবে আরো ভালো একটি দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠতে পারে। দিঘীরপাড় ইউপি চেয়ারম্যান বলেন,রাজাবাড়ী দিঘীরপাড় পদ্মাচরটি ইতিহাস সমৃদ্ধশালী একটি দর্শনীয় স্থান।ঐতিহ্যবাহী রাজাবাড়ীর বেশ কিছ’ অংশ এখনো এই পদ্মাচর জুড়ে অবস্থিত আছে। প্রায় ১৫০ বছরের পুরানো ইতিহাস ঐতিহ্যবাহী স্থান ও পদ্মাচরটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সকলের।১৯৯০ সালে পদ্মানদীতে ভেঙ্গে যাবার কয়েক বছর পর আবার এই চরটি জেগে উঠে।বর্তমানে পদ্মার শাখা নদীর তীর ঘেঁসে যে দিঘীরপাড় বাজারটি আছে,এই বাজারটিই একসময় এখানে অবস্থিত ছিলো।নদী ভাঙ্গার পূর্বে দূরদূরান্তের মানুষ রাজাবাড়ী দিঘীরপাড় নামেই চিনতেন।কখনো প্রত্যাশা করিনি রাজাবাড়ী দিঘীরপাড় এলাকাটি পদ্মানদীতে ভেঙ্গে যাবার পর পুনরায় এতো সুন্দর প্রাকৃতিক রূপ দিয়ে বিধাতা আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিবেন।
|