অবশ্যই কেয়ামতের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর এমন বহু মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পাবে, যাতে তার সমকক্ষ কেউ হবে না। সর্বপ্রথম তাঁরই জমিনের কবর উন্মোচিত হবে। তিনি সওয়ারির ওপর আরোহণ করে হাশরের ময়দানের দিকে যাবেন। তাঁর কাছে একটি পতাকা থাকবে, যার নিচে আদম (আ.) সহ সবাই থাকবেন। তাঁকে হাউজে কাউসার দান করা হবে
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করবে, এটি তোমার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন মাকামে মাহমুদ বা প্রশংসিত স্থানে।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৭৯)। মাকামে মাহমুদ হলো শাফায়াতে কুবরা বা বড় সুপারিশ। আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত সুপারিশের অধিকারই হলো মাকামে মাহমুদ। এর দ্বারা জান্নাতের বিশেষ কোনো স্তর বোঝানো হয়নি। এখানে আল্লাহ তায়ালা হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে তাহাজ্জুদ সালাতের (নামাজের) নির্দেশ দিচ্ছেন। ফরজ সালাতের নির্দেশ তো আগে থেকে রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত; সেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হয়, ফরজ সলাতের পর কোন সালাত উত্তম? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘(রাতের) তাহাজ্জুদ সালাত।’ (মুসলিম : ২/৮২১)।
তাহাজ্জুদ সালাত বলা হয় রাতে ঘুম থেকে উঠে আদায়কৃত সালাতকে। আলকামাহ, আসওয়াদ, ইবরাহিম নাখয়ি (রহ.) সহ আরও অনেকে এ মত দিয়েছেন। আরবি অভিধানেও এ ধরনের কথা বলা হয়েছে। বহু হাদিস থেকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অভ্যাস ছিল, তিনি ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করতেন। তবে হাসান বসরি (রহ.) বলেন, এশার পরে যে সালাত আদায় করা হয়, তা-ই তাহাজ্জুদ সালাত। খুব সম্ভব এ উক্তির দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, এশার পরে ঘুমানোর পর উঠে যে সালাত আদায় করা হয়, তা-ই তাহাজ্জুদ সালাত। (তাবারি : ১৭/৫২৪)। তাহাজ্জুদ শব্দটি নিদ্রা যাওয়া ও জাগ্রত হওয়া এ দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। আয়াতের অর্থ রাতের কিছু অংশে কোরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকুন। কেননা ‘বিহি’ সর্বনাম দ্বারা কোরআন মজিদ বোঝানো হয়েছে। (মাজহারি)। আলোচ্য আয়াত দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সা.) কে মাকামে মাহমুদের ওয়াদা দেয়া হয়েছে। এটি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জন্য নির্দিষ্ট বিশেষভাবে, অন্য কোনো নবীর জন্য নয়। সহি হাদিসগুলোয় স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত আছে, এটি হচ্ছে শাফায়াতে কুবরার মাকাম। হাশরের মাঠে সবাই একত্রিত হবে, আর প্রত্যেক নবীর কাছে যাবে শাফায়াতের জন্য। সব নবীই ওজর দেখাবেন। একমাত্র রাসুলুল্লাহ (সা.) এ মহান সম্মান লাভ করবেন এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য শাফায়াত করবেন। মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.) বলেন, এ আয়াতে প্রথমে রাসুলুল্লাহ (সা.) কে তাহাজ্জুদ সালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে; এর পর মাকামে মাহমুদ বা শাফায়াতে কুবরার ওয়াদা দেয়া হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, শাফায়াতের মর্তবা অর্জনে তাহাজ্জুদ সলাতের বিশেষ প্রভাব বিদ্যমান। আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর স্থান অন্য সবার ঊর্ধ্বে। আল্লাহ তাকে উচ্চ প্রশংসা ও গৌরবের অধিকারী করেছেন। মুহাম্মদ শব্দের অর্থও প্রশংসিত। হে নবী, তুমি আমার এ নির্র্দেশ পালন করলে (তাহাজ্জুদ কায়েম করলে), আমি তোমাকে এমন স্থানে প্রতিষ্ঠিত করব যেখানে প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে সব সৃষ্ট জীব তোমার প্রশংসা করবে আর স্বয়ং আল্লাহও প্রশংসা করবেন। ইবনে জারির (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে, অধিকাংশ মন্তব্য করেছেন, কেয়ামতের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তার উম্মতের শাফায়াতের জন্য এ মাকামে মাহমুদে যাবেন, যাতে সেদিনের কোনো কোনো ভয়াবহতা থেকে তিনি তার উম্মতের জন্য শান্তি আনয়ন করতে পারেন। (তাবারি : ১৭/৫২৬)। হুজায়ফা (রা.) বলেন, সব মানুষকে একই ময়দানে একত্রিত করা হবে। ঘোষণাকারীর ঘোষণা শোনা যাবে এবং তাদের সবাইকে দেখা যাবে। তারা খালি পায়ে ও নগ্ন দেহে থাকবে, যেভাবে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছিল। সবাই দাঁড়িয়ে থাকবে। আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না। বলা হবে, হে মুহাম্মদ! রাসুলুল্লাহ (সা.) জবাবে বলবেন, হে আমার রব আপনার খেদমতে উপস্থিত। সব কল্যাণ আপনার হাতে, অকল্যাণ আপনার পক্ষ থেকে নয়। সে সুপথপ্রাপ্ত যাকে আপনি সুপথ দেখিয়েছেন। আপনার দাস আপনার সামনে বিদ্যমান। সে আপনার সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং আপনার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আপনার দয়া ছাড়া কেউ আপনার পাকড়াও থেকে রক্ষা পাবে না। আপনার দরবার ছাড়া আর কোনো আশ্রয়স্থল নেই। আপনি কল্যাণময় সুউচ্চ। আপনিই তো পবিত্র গৃহের (কাবার) মালিক। এটিই হলো মাকামে মাহমুদ, যার উল্লেখ আল্লাহ এ আয়াতে করেছেন। (তাবারি : ১৭/৫২৬)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, এ স্থানই হচ্ছে শাফায়াতের স্থান। (তাবারি : ১৭/৫২৭)। ইবনে আবি নাজিহ, মুজাহিদ ও হাসান বসরি (রহ.) এ ধরনের মন্তব্য করেছেন। কাতাদাহ (রহ.) বলেন, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম জমিন থেকে বের হবেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। সর্বপ্রথম তিনিই শাফায়াত করবেন। (তাবারি : ১/৫২৮)। জ্ঞানীরা বলেন, এটিই মাকামে মাহমুদ। যার ওয়াদা আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিবের (সা.) সঙ্গে করেছেন আয়াতে। অবশ্যই কেয়ামতের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর এমন বহু মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পাবে, যাতে তার সমকক্ষ কেউ হবে না। সর্বপ্রথম তাঁরই জমিনের কবর উন্মোচিত হবে। তিনি সওয়ারির ওপর আরোহণ করে হাশরের ময়দানের দিকে যাবেন। তাঁর কাছে একটি পতাকা থাকবে, যার নিচে আদম (আ.) সহ সবাই থাকবেন। তাঁকে হাউজে কাউসার দান করা হবে। যার কাছে সবচেয়ে বেশি লোক জমায়েত হবে। শাফায়াতের জন্য মানুষ আদম (আ.), নুহ (আ.), ইবরাহিম (আ.), মুসা (আ.) এবং ঈসা (আ.) এর কাছে যাবে; কিন্তু তারা সবাই অস্বীকার করবেন এবং তারা প্রত্যেকে বলবেন, আমি এটি করতে সক্ষম হব না। শেষ পর্যন্ত তারা মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে আসবেন সুপারিশের জন্য। তিনি সক্ষম হবেন। যাদের জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার হুকুম হবে, তাদের ব্যাপারে তিনিই সুপারিশ করবেন। অতঃপর তাদেরকে তার সুপারিশের কারণে ফিরিয়ে আনা হবে। সর্বপ্রথম তার উম্মতের ফয়সালা করা হবে। তিনিই নিজের উম্মতসহ সর্বপ্রথম পুলসিরাত পার হবেন। জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনিই প্রথম সুপারিশকারী। (মুসলিম : ১/১৮২)।