ম্যারাডোনার সম্পত্তি নিয়ে লড়াইয়ে ছয় নারীর ১০ সন্তান!
তারিথ
: ০৭-১২-২০২০
অনলাইন ডেস্ক :
চোখ-ধাঁধানো ফুটবল খেলে বিপুল অর্থ কামিয়েছিলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা। হয়েছিলেন বহু বাড়ি, লোভনীয় প্রচারস্বত্ব থেকে শুরু করে বেলারুস থেকে পাওয়া উভচর ট্যাংকের মতও বহু সম্পত্তির মালিক। কিন্তু গত সপ্তাহে ৬০ বছর বয়সে মারা যাবার পর দেখা যাচ্ছে- ম্যারাডোনা যে অর্থ-সম্পদ রেখে গেছেন, তার উত্তরাধিকার নিয়ে এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে।
ম্যারাডোনার ব্যক্তিগত জীবনে বহু নারীর আসা-যাওয়া এবং তাদের গর্ভজাত সন্তানদের কারণেই এই জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা। কাজেই তিনি মারা যাবার সাথে সাথে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে- তার সম্পদের পরিমাণ কত এবং ঠিক কতজন তার উত্তরাধিকারের দাবিদার হবেন- তা নিয়ে।
মূলত, ম্যারাডোনার ছিল এক বিশাল পরিবার। ছয়জন নারীর সঙ্গে কয়েক দশকব্যাপী রোমান্টিক সম্পর্কের সূত্রে তাদের গর্ভে কমপক্ষে ৮টি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ফুটবল ইশ্বর। মনে করা হচ্ছে- তার সম্পত্তি এই সন্তানদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হবে।
কিন্তু আর্জেন্টিনার আইন বিশেষজ্ঞ এবং সাংবাদিকরা বলছেন, ম্যারাডোনা কোনও উইল করে গেছেন বলে জানা যায়নি। তাই তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ঠিক করাটা কোনও সহজ-সরল ব্যাপার হবে না।
ম্যারাডোনার এই সন্তানেরা কারা? একজন সফল ফুটবলার হিসেবে ম্যারাডোনার জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। আর নানা নারীর গর্ভে ম্যারাডোনার সন্তান জন্মের খবর ছিল সেই জীবনের একটা নিয়মিত ঘটনা। ম্যারাডোনার এক কন্যা একবার ঠাট্টা করে বলেছিলেন- তার পিতার সন্তানের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে পুরো একটা ১১ জনের ফুটবল দল হয়ে যাবে।
অবশ্য ম্যারাডোনা নিজে অনেক দিন ধরেই দাবি করে আসছিলেন- তার প্রথম স্ত্রী ক্লডিয়া ভিলাফানের গর্ভে জন্মানো দুই মেয়ে জিয়ানিনা (বর্তমানে বয়স ৩১) এবং ডালমা (বর্তমান বয়স ৩৩) ছাড়া তার আর কোনও সন্তান নেই।
বিশ বছরের বিবাহিত জীবনের পর ২০০৩ সালে ক্লডিয়ার সাথে ম্যারাডোনার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরে অবশ্য ম্যারাডোনা স্বীকার করেন যে- তিনি আরও ৬টি সন্তানের পিতা।
বছর পাঁচেক আগে ক্রিস্টিনা সিনাগ্রা এবং ভ্যালেরিয়া সাবালাইন নামে দুই নারীর সঙ্গে আদালতে আইনী লড়াইয়ের পর ম্যারাডোনা স্বীকার করেন যে- তাদের দুই সন্তান যথাক্রমে দিয়েগো জুনিয়র (৩৪) এবং জানা-র (২৪) পিতা তিনিই।
এর আগে ২০১৩ সালে ভেরোনিকা ওইয়েদা নামে এক নারীর গর্ভে তার দ্বিতীয় পুত্র দিয়েগো ফার্নান্দোর জন্ম হয়। তাকে নিয়ে অবশ্য কোনও মামলা হয়নি।
এরপর ২০১৯ সালে ঘটে এক বিস্ময়কর ঘটনা। সবাইকে তাজ্জব করে দিয়ে ম্যারাডোনার আইনজীবী ঘোষণা করেন যে- কিউবায় জন্মানো তিনটি শিশুর পিতৃত্ব স্বীকার করতে রাজি হয়েছেন বিশ্বকাপজয়ী এই আর্জেন্টাইন ফুটবলার।
ব্যাপারটা হলো- কোকেন আসক্তি থেকে সেরে ওঠার চিকিৎসার জন্য ২০০০ সালের পর থেকে বেশ কয়েক বছর ম্যারাডোনা কিউবায় কাটিয়েছিলেন।
আর এতেই যদি আপনি মনে করেন যে, হিসেব মেলানো শেষ- তাহলে ভুল করছেন। কারণ এখন জানা যাচ্ছে, আরও অন্তত: দু`জন আছেন- যারা মনে করেন ম্যারাডোনাই তাদের পিতা।
এরা হলেন- সান্টিয়াগো লারা (বর্তমানে বয়স ১৯) আর মাগালি জিল (বয়স ২৩)। এরা দুজনেরই দাবি অনুযায়ী, ম্যারাডোনাই যে তাদের পিতা- তা প্রমাণ করার জন্য তারা আইনী ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ম্যারাডোনার সম্পত্তির উত্তরাধিকার দাবি করতে হলে এই প্রমাণটা তাদের দরকার।
এহেন অবস্থায় ম্যারাডোনার মৃতদেহ কবর থেকে তোলা হতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে। হ্যাঁ, এমন সম্ভাবনা সত্যিই আছে। লারার আইনজীবী ইতোমধ্যেই আদালতের কাছে এ আর্জি পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন- ডিএনএ টেস্টের জন্য নমুনা সংগ্রহ করতে ম্যারাডোনার দেহ কবর থেকে তোলা দরকার।
তবে মি. লারা ও মিস জিল যদি শেষ পর্যন্ত এটা প্রমাণ করতে সক্ষমও হন যে, ম্যারাডোনাই তাদের পিতা- তাহলেও তারা কি পরিমাণ সম্পত্তি পাবেন সেটা স্পষ্ট নয়। তবে আইনজীবীরা এখন ম্যারাডোনার ভূসম্পত্তির প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করার জন্য হিসেব-নিকেশে ব্যস্ত।
তারা মনে করছেন- প্রয়াত এই ফুটবলারের সম্পত্তির অংশ পাবার জন্য আদালতে দীর্ঘ আইনি লড়াই হতে পারে। হতে পারে পারিবারিক বিবাদও। ডিএনএ টেস্ট থেকে শুরু করে সম্পত্তির ভাগ পাবার মতলবে কেউ কেউ হয়তো `ম্যারাডোনার সন্তানের` সুযোগসন্ধানী দাবিও তুলে বসতে পারেন।
বুয়েনস আইরেসের একজন আইনজীবী এলিয়াস কির জফে বলছেন- আমার মনে হয় ম্যারাডোনার সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা এক মহা বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর এর জট ছাড়াতে অনেক সময় লেগে যাবে।"
ম্যারাডোনার সম্পত্তির মূল্য কত? ম্যারাডোনা কী পরিমাণ সম্পত্তি মালিক ছিলেন, তা নিয়ে কোন বিশদ রিপোর্ট নেই। তবে অনুমাননির্ভর নানা খবর মিডিয়ায় বেরিয়েছে। দু`ভাবে এসব হিসেব করা হয়েছে। একটি হলো- স্পোর্টস কার থেকে শুরু করে ধনরত্ন পর্যন্ত তার জানা সম্পদগুলো মোট মূল্য নির্ধারণ।
আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক হিসাবে বলা হয়- তার সম্পত্তির মূল্য ৭৫ মিলিয়ন (সাড়ে ৭ কোটি) ডলার থেকে ১০০ মিলিয়ন (১০ কোটি) ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এতে বলা হচ্ছে- ম্যারাডোনার ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হুলিও শিয়াপেত্তার লেখা এক নিবন্ধ থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় অনুমানটির জন্য ম্যারাডোনার মোট সম্পত্তি ও বকেয়া বা ঋণের হিসেব করা হয়েছে। সেলেব্রিটি নেট ওয়ার্থ নামে একটি ওয়েবসাইট, যারা বিখ্যাত লোকদের অর্থবিত্তের ওপর রিপোর্ট করে, তারা বলছে- আর্থিক বিশ্লেষণ, বাজার গবেষণা এবং গোপন সূত্রের খবর, সব কিছু বিবেচনা করে তাদের মতে- ম্যারাডোনার মোট সম্পদের মূল্য ৫ লাখ ডলার।
ম্যারাডোনার কিছু সম্পত্তির খবর ব্যাপকভাবে সংবাদমাধ্যমে বেরিয়েছে। এর মধ্যে আছে-
১. আর্জেন্টিনায় অন্তত পাঁচটি বাড়ি। তবে আইনজীবী জফের মতে- এগুলোকে কোনও "বেভারলি হিলসের প্রাসাদ বলা যায় না।"
২. একটি রোলস রয়েস গোস্ট (মূল্য প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার) এবং একটি বিএমডব্লিউ আই-এইট (দাম ১ লাখ ৭৫ হাজার ডলার)।
৩. বেলারুসে সফরের সময় ম্যারাডোনাকে উপহার দেয়া একটি `হান্টার ওভারকামার` উভচর গাড়ি।
৪. একটি হীরের আংটি, দাম ৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
৫. কোমানির সঙ্গে একটি চুক্তি, যাতে তারা প্রো-ইভোলিউশন সকার নামে ভিডিও গেমে ম্যারাডোনার মতও দেখতে একটি চরিত্র ব্যবহার করতে পারে।
ম্যারাডোনা যেমন অর্থ আয় করেছেন, তেমনি উড়িয়েছেনও। সেলেব্রিটি নেট ওয়ার্থ বলছে- ম্যারাডোনা খেলোয়াড় ও ম্যানেজার হিসেবে তার বেতন ও বিজ্ঞাপন থেকে কোটি কোটি ডলার আয় করেছেন। এর একটা বড় অংশ এসেছিল ইতালির নাপোলি ক্লাবে খেলার সময়।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, তখন ম্যারাডোনা বেতন পেতেন ৩০ লাখ ডলার, তার ওপর বিজ্ঞাপন থেকে পেতেন ৮০ লাখ থেকে এক কোটি ডলার পর্যন্ত। কিন্তু ইতালি তাকে যেমন দিয়েছে, তেমনি নিয়েছেও। ২০০৫ সালে ইতালির সরকার জানায়, ম্যারাডোনার ৩ কোটি ৭২ লাখ ডলারের কর অপরিশোধিত আছে।
ম্যারাডোনা এই কর দিতে অস্বীকার করেছিলেন এবং মারা না গেলে হয়তো কখনও দিতেনও না। কিন্তু এর জন্য সেলেব্রিটি নেটওয়ার্থের হিসেবে তার সম্পদের মূল্য দাঁড়ায় ৫ লক্ষ ডলার- তা তেমন বড় কোনও অংক নয়।
ম্যারাডোনার এক বন্ধু সাংবাদিক লুই ভেনচুরা বলেন, ম্যারাডোনা দু-হাতে টাকা খরচ করতেন একথা সবাই জানেন। এক টিভি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, মারা যাবার সময় ম্যারাডোনার তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। বলতে গেলে তিনি দরিদ্র অবস্থাতেই মারা গেছেন।
কিভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে? ম্যারাডোনার সঙ্গে তার সাবেক স্ত্রী, বান্ধবী বা ছেলেমেয়েদের প্রকাশ্যে ঝগড়া-বিবাদ হয়েছে। তিনি একবার তার মেয়ে জিয়ানিনার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "আমি তোমাকে বলছি, আমি কিছু রেখে যাবো না- আমি সবকিছু দান করে দেবো।"
তবে আর্জেন্টিনার আইন অনুযায়ী, একজন তার সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ দান করতে পারেন। তবে বাকিটা তার স্ত্রী বা স্বামী এবং সন্তানরা পাবে।
কিন্তু যেহেতু তিনি কোনও উইল করে যাননি এবং মৃত্যুর সময় তার কোনও বিবাহিত স্ত্রীও ছিলেন না- তাই তার সব সম্পত্তিই সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে।
এ অবস্থায় যদি কেউ নিজেকে ম্যারাডোনার উত্তরাধিকারী মনে করেন- তিনি স্বীকৃত হোন বা না হোন- তাকে তার মৃত্যুর ৯ দিনের মধ্যে সম্পত্তির ভাগ চেয়ে আবেদন করতে হবে। ম্যারাডোনার তৃতীয় কন্যা জানা ইতিমধ্যেই আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে।
উত্তরাধিকারীদের নাম ঘোষণা এবং সম্পত্তি ভাগ করে কাকে কি দেয়া হবে তা ঠিক করবেন একজন বিচারক, জানিয়েছেন একজন আইনজীবী। তবে এর নিষ্পত্তি হতে কয়েক মাস পর্যন্ত লাগতে পারে বলেই জানা গেছে। -বিবিসি।