অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবক্তা যুগস্রষ্টা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মহানায়ক মহাকবি মাইকেল মধূসূদন দত্তের ১৯৪ তম জন্মজয়ন্তী আজ ২৫ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার। যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের ক্ষনজন্মা মহাপুরুষ, প্রাণের কবি, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক আধুনিক বাংলা কাব্যের রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সাগরদাঁড়ি গ্রামের স্থানীয় জমিদার পিতা রাজনারায়ন দত্ত আর মাতা জাহ্নবী দেবীর কোল আলোকিত করে সোনার চামচ মুখে নিয়ে বাঙ্গালীর প্রিয় কবি এই পৃথিবীতে আর্বিভূত হন। প্রাকৃতিক অপূর্ব লীলাভূমি, পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা, শষ্য সম্ভারে সম্বৃদ্ধ সাগরদাঁড়ি গ্রাম আর বাড়ির পাশে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী কপোতাক্ষের সাথে মিলেমিশে তার সুধা পান করে শিশু মধুসূদন ধীরে ধীরে শৈশব থেকে কৈশোর এবং কৈশোর থেকে পরিনত যুবক হয়ে উঠেন। কপোতাক্ষ নদ আর মধুসূদন” দু’জনার মধ্যে গড়ে উঠে ভালবাসার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। মধুকবি ১৮২৪ সালে যখন জন্ম গ্রহন করেন সে সময়ে আজকের এই মৃত প্রায় কপোতাক্ষ নদ কাকের কালো চোখের মত স্বচ্ছ জলে কানায় কানায় পূর্ন আর হরদম জোঁয়ার ভাটায় ছিল পূর্ণযৌবনা। নদের প্রশস্ত বুক চিরে ভেসে যেত পাল তোলা সারি সারি নৌকার বহর আর মাঝির কন্ঠে শোনা যেত হরেক রকম প্রাণ উজাড় করা ভাটিয়ালী ও মুর্শিদি গান। শিশু মধুসূদন এসব অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখত আর মুগ্ধ হয়ে যেত। স্রোতস্বিনী কপোতাক্ষের অবিশ্রান্ত ধারায় বয়ে চলা জলকে মায়ের দুধের সাথে তুলনা করে কবি তাই রচনা করলেন সেই বিখ্যাত সনেট কবিতা ‘কপোতাক্ষ নদ’। তিনি লিখলেন- ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমারি কথা ভাবি এ বিরলে’। ছেলেবেলায় নিজ গ্রামের এক পাঠশালায় মাওলানা লুৎফর রহমানের কাছে শিশু মধুসূদন তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পাশাপাশি গৃহ শিক্ষক হরলাল রায়ের কাছে বাংলা ও ফারসি ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা তার মা জাহ্নবী দেবীর কাছ থেকেই শুরু করেছিলেন। জাহ্নবী দেবীই শিশু মধুসূদনকে রামায়ন, মহাভারত, পুরান প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের সাথে পরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়িতে বাল্যকাল অতিবাহিত করে ১৩ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় আসেন। আইনজীবী পিতা রাজনারায়ন দত্ত কর্মের জন্য পরিবার নিয়ে কলকাতার খিদিরপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় খিদিরপুর স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তদানিন্তন হিন্দু কলেজের (বর্তমানে প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়) জুনিয়র বিভাগে ভর্তি হন। ১৮৪১ সালে তিনি এই কলেজের সিনিয়র বিভাগে প্র্েবশ করেন। কৃতী ছাত্র হিসাবে তার সুনাম ছিল। কলেজে অধ্যয়ন কালে তিনি নারী শিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে স্বর্ণ পদক লাভ করেছিলেন। এ সময় মধুসূদন মহাকবি হওয়ার স্বপ্নে মরিয়া হয়ে ওঠেন। বিলেত যাওয়ার সুবিধার জন্য তিনি ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করেন। নামের আগে যোগ করেন “মাইকেল”, যদিও তার সে সময় বিলেত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ধর্মান্তরিত হওয়ায় জমিদার পিতার রোষানলে পড়ে ত্যাজ্যপুত্র হতে হলো। খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করায় একই বছর তাকে হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হয়। পরে তিনি শিবপুরের বিশপ কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি গ্রীক, ল্যাটিন, সংস্কৃতি ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ধর্ম পরিবর্তনের কারণে একসময় পিতা, মাতা, আত্মীয়স্বজন থেকে দুরে চলে যেতে হয়। পিতাও তাকে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেন। ১৮৪৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মধুসূদন জীবিকার তাগিদে মারাজে চলে যান। প্রথমে এক অনাথ আশ্রমে মাদ্রাজের অরফান মেইল আসাইলামের স্কুলে সামান্য বেতনে শিক্ষকতার চাকরি পান। ১৮৪৮ সালের ৩১ জুলাই রিয়ে করেন রেবেকা ম্যাটকা ভিশকে। রেবেকা ছিলেন শ্বোতাঙ্গিনী। তার পিতামাতার পরিচয়ও ঠিকমত পাওয়া যায়নি। মাদ্রাজেই কবির আত্মপ্রকাশ ঘটে। মাদ্রাস থেকেই কবি শিখে নেন হিব্রু, ফরাসি, ইটালিয়ান, তামিল ও তেলেগু ভাষা। এখান থেকেই ধারদেনা করে প্রথম কাব্য প্রকাশ করেন যার নাম পধঢ়ঃরাব ষধফরপ।। বিদেশী ভাষায় জ্ঞানার্জন করার পাশাপাশি এখানে বসেই তিনি রচনা করেন বাংলায় সনেট বা চর্তুদ্দশপদী কবিতা। সেখানে চলাফেরার একপর্যায়ে মধুসূদন পর্যায়ক্রমে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষ জীবনে ভয়ংঙ্করভাবে অর্থাভাব, ঋণগ্রস্ত ও অসুস্থতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন দূর্বিষহ উঠেছিল। ফিরে আসেন আবারো কলকাতায়। এ সময় তার পাশে ২য় স্ত্রী ফরাসি নাগরিক হেনরিয়েটা ছাড়া আর কেউ ছিল না। এরপর সকল চাওয়া পাওয়াসহ সকল কিছুর মায়া ত্যাগ করে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার একটি হাসপাতালে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পেছনে ফেলে রেখে যান একগুচ্ছ মনোকষ্ট আর অভিমান। মহাকবির মৃত্যুর পর ১৮৯০ সালে কবির ভাইয়ের মেয়ে মানকুমারি বসু সাগরদাঁড়িতে প্রথম স্মরনসভার আয়োজন করেন। এরপর ১৯৮০ সাল থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় যশোর জেলা প্রশাসনের অয়োজনে মহাকবির স্মৃতি বাচিয়ে রাখতে শুরু হয় সপ্তাহব্যাপী মধুমেলায়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাংগালীর বৃহৎ প্রাণের মেলা কপোতাক্ষ পাড়ের তীর্থভূমির এই মধুমেলা। বার বার এখানে আসলেও যেন কপোতাক্ষের সেই সুধা যেন পান করা হয়ে ওঠে না। তাইতো কবি তার শেষ যাত্রায় লিখে গেছেন--- “সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমারি কথা ভাবি এ বিরলে”। তিনি সুদুর ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসে মার্র্তভাষা বাংলায় নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য সাহিত্য কর্ম। মেঘনাধ বধ কাব্য, শর্মীষ্ঠা নাটক ,বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রো নাটক.কৃষ্ণ কুমারী নাটক, সহ অসংখ্য সাহিত্য কর্ম রচনা করেন অল্প সময়ে। ছেলেবেলায় নিজ গ্রামের এক পাঠশালায় মাওলানা লুৎফর রহমানের কাছে শিশু মধুসূদন তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন। কিন্তু গাঁয়ের পাঠশালায় তিনি বেশি দিন শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। পিতা রাজনারায়ন দত্ত কর্মের জন্য পরিবার নিয়ে কলকাতার খিদিরপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। সেখানে মধুসূদন দত্তকে চলে যেতে হয়। শেষ জীবনে অর্থাভাব, ঋণগ্রস্ত ও অসুস্থতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন দূর্বিষহ উঠেছিল। এরপর সকল চাওয়া পাওয়াসহ সকল কিছুর মায়া ত্যাগ করে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতায় তিনি মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দিবসটি স্মরণে প্রতিবছর সং®কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠ পোষকতায় যশোর জেলা প্রশাসনের আয়োজনে কেশবপুরের সাগরদাঁড়িতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম জয়ন্তি ও সপ্তাহব্যাপী মধু মেলার আয়োজন করে থাকে। এবারও সাগরদাঁড়িতে মহাকবির জন্ম জয়ন্তিতে বর্ণাঢ্য আয়োজন করা হয়েছে। মেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানূর রহমান জানান, প্রতিবারের ন্যায় এবারও দু’জন গুনী মানুষকে মধুসূদন পদক দেয়া হবে। আগামিকাল ২৬ জানুয়ারী পদক বিতরণ করা হবে। এসএসসি পরীক্ষার কারণে মেলা এগিয়ে ২০ জানুয়ারী উদ্বোধন করেন এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপি। ২৬ জানুয়ারী সন্ধ্যায় খুলনার বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে দুজন গুনীজনকে মধুসূদন দত্ত পদক-২০১৮ প্রদান করবেন। ২৬ জানুয়ারী রাতেই মেলার পর্দা নামবে বলে জানান মেলা উদযাপন সভাপতি জেলা প্রশাসক আশরাফউদ্দীন।