অনেকদিন আগের কথা। এক গ্রামে বাস করতো এক রাখাল। ছোট বেলায় গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করতো সে। পাড়ার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বুদ্ধি আর দুষ্টুমিতে সেরা হলেও মন বসতো না কেবল পড়াশোনায়। সারাদিন দুষ্টুমি আর হৈ-হুল্লোর করে বেড়াতে ভালো লাগতো তার। স্কুলের পন্ডিত মশাই পড়া দিলেও সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না রাখালের। পড়া না হলে পন্ডিত মশাইয়ের বেতের মাইর থেকে রেহাই মিলতো না কারো। করে রাখতেন বেঞ্চ বা পাকা মেঝের উপর নীল ডাউন। অন্যান্য পন্ডিত মশাইরাও মারতেন, কিন্তু ওই পন্ডিত মশাই মারতেন একটু বেশিই। রাখালকে পড়াশোনায় এগিয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না পন্ডিত মশাইয়ের। কিন্তু কিছুতেই পড়াশোনায় মনোযোগ ছিল না তার। একদিন ক্লাসেই পড়া পড়তে দিয়ে অফিস কক্ষে যান পন্ডিত মশাই। রাখাল দুষ্টুমি করে জোরে জোরে পড়তে থাকে- কলসি আন, কান্দা আন। কলসি আন, কান্দা আন। পড়া হয়েছে কি না যাচাই করতে আবার ক্লাসে আসেন পন্ডিত মশাই। পন্ডিত মশাই যা দিয়েছেন তা না পড়ে রাখাল করছে দুষ্টুমি আর পড়ছে কলসি আন, কান্দা আন। এ আবার কেমন পড়া! এমনটি দেখে, দিলেন বেতের মাইর, মাইর খেয়ে রাখাল পন্ডিত মশাইকে গালি দিয়েই ভাঙা জানালা দিয়ে এক লাফেই পাড় হয়ে দেয় ভোঁদৌড়। পণ করেছে আর স্কুলে যাবে না সে। রাখালের বাবা জানতেন লেখাপড়া, করতেন কৃষিকাজ। ছিল বেশ কয়েকটি গরুও। ছেলেকে বুঝালেন শিক্ষক বাবা-মার চেয়ে অনেক বড়। বললেন, `বাপ-মা বানায় ভুত আর শিক্ষক বানায় পুত।` শিক্ষকের মাইর হলো আশির্বাদ। যাও বাবা, স্কুলে যাও। স্কুলের পথের ধারে ছিল বড় বড় দুটো জঙ্গল। বাবার কথা মতো স্কুলে যাওযা শুরু করলো রাখাল। কিন্তু সেখানে না গিয়ে ওই জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতো সে, খেলতো মার্বেল। স্কুল ছুটি হলে ফিরতো বাড়িতে। এভাবে চলছিল বেশ কিছুদিন। ছেলের স্কুল ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে বাবা লাগিয়ে দেন তাকে গরু চরাতে। যথেষ্ট জ্ঞান-বুদ্ধি ছিল রাখালের। বিশেষ করে জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ে আইন-কানুন বেশ ভালো জানতো সে। স্মরণশক্তি এতোটাই প্রখর ছিল যে, পড়তে কিংবা লেখতে না জানলেও কোনো কিছু পড়ে শোনালে কিংবা বললেই তা মনে রাখতো সে। চার দশকের বেশি সময় ধরে চরাঞ্চলে গরু চরানোয় সখ্যতা গড়ে ওঠে সেখানকার মানুষের সাথে। জমিজমা নিয়ে বিবাদ সৃষ্টি হলে জমির দলিল ও বিভিন্ন কাগজ পড়ে শোনালেই বলে দিতে পারতো কে বা কারা পাবেন সেই জমি। উকিলের কাছে বুুঝতে গেলেও মিলে যেত রাখালের দেওয়া রায়। সেই থেকেই রাখাল পরিচিতি পেয়ে যায় কানা উকিল হিসেবে। ডাকে জমিজমা নিয়ে শালিসে। শালিসে তার জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে তাজ্জব বনে যান শিক্ষিতরাও। সবাই বলে, সেদিন পন্ডিতের মাইর হজম করে রাখাল যদি পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারতো তবে কানা উকিল নয়, হতে পারতো হয়তো সত্যিকারের একজন উকিল। পন্ডিত মশাইয়ের সাথে দুর্ব্যবহার ও স্কুল ছেড়ে দেওয়া নিয়ে অনুতপ্ত হয় রাখাল, আর ভাবে ইশ! কী ভুলটাই না করেছিলাম সেদিন। সংগ্রহ
এম এ মাসুদ উপজেলা প্রতিনিধি সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা।