সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে গোলযোগ হওয়া কয়েকটি কেন্দ্রে নতুন করে ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদর উদ্দীন আহমদ কামরান। ভোটের পরদিন গতকাল মঙ্গলবার নগরীর ছড়ারপাড়ে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে, জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্র দখল করে ধানের শীষে ভোট দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু কেন্দ্রে মারামারি হয়েছে, ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। গত সোমবার এ নির্বাচনে সিলেটের ১৩৪ কেন্দ্রের মধ্যে দুটি গোলযোগের কারণে স্থগিত করা হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ১৩২ কেন্দ্রের যে ফলাফল ঘোষণা করেছেন, তাতে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ৯০ হাজার ৪৯৬ ভোট। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী কামরান নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৮৭০ ভোট। শীর্ষ দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান স্থগিত দুটি কেন্দ্রের ভোটের চেয়ে কম হওয়ায় রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান গত সোমবার ফল ঘোষণা করেননি। তিনি বলেছেন, দুই কেন্দ্রে আবার ভোট হওয়ার পর তার ভিত্তিতে ফল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু সিলেটের দুই বারের মেয়র কামরান তাতে সন্তুষ্ট নন। গোলযোগ হয়েছে এমন ১৭-১৮ টি কেন্দ্রে নতুন করে ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি। সোমবারের ভোটে মানুষ তার অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি অভিযোগ করে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, বিএনপি কূট কৌশলের মাধ্যমে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সিলেটের মানুষ এটা মেনে নেবে না। উল্লেখ্য, দুই প্রধান প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান স্থগিত দুটি কেন্দ্রের ভোটের চেয়ে কম হওয়ায় সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদের ফল ঘোষণা হয়নি। ১৩৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৩২টি কেন্দ্রের ফলাফলে এগিয়ে আছেন বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী, ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ৯০ হাজার ৪৯৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বদর উদ্দীন আহমদ কামরান নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৮৭০ ভোট। গত সোমবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে দুটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হয়; সেখানে মোট ভোট সংখ্যা ৪ হাজার ৭৮৭টি। শীর্ষ দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান এর চেয়ে কম ৪ হাজার ৬২৬টি হওয়ায় ফল ঘোষণা করেননি রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান। গত সোমবার রাত সাড়ে ১১টার পর তিনি যখন নগরীর উপশহরে স্থাপিত ফল ঘোষণা কেন্দ্র থেকে এই সিদ্ধান্ত জানান তার আধা ঘণ্টা আগে গণনায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে পুনর্গণনার দাবি জানানো হয় কামরানের শিবির থেকে। এসময় বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক ফল ঘোষণার ওই কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই অনিয়মের অভিযোগ তুলে বলেছিলেন, ফল যাই হোক না কেন, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘোষণার পর সেখানে উপস্থিত আরিফুল সাংবাদিকদের বলেন, তারা সারাদিন চেষ্টা করেছে লোকজন যেন ভোটকেন্দ্রে না আসে। কিন্তু মানুষকে দূরে রাখা যায়নি। তারা এসেছেন এবং ভোট দিয়েছেন। এ বিজয় জনগণের বিজয়। ফল প্রত্যাখ্যানের অবস্থান থেকে সরে আসছেন কি না- এই প্রশ্নে বিএনপি প্রার্থী বলেন, এটা ফলাফল প্রত্যাখান না। যেখানে কেন্দ্র দখল হয়েছে, যেখানে জাল ভোট হয়েছে, যেখানে ভোটারদের বাধা দেওয়া হয়েছে, আমি সেসব বিষয়কে ঘৃণা জানিয়েছি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী কামরান এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। রাত ১১টায় কামরানের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে ভোট পুনর্গণনার দাবি তোলেন। মতিনি বলেন, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তারা যে ফলাফল পেয়েছেন, তা রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘোষিত ফলাফলের সঙ্গে মিলছে না। সিরাজ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত, ভোট পুনর্গননা এবং কয়েকটি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট নেওয়ার জন্য বলেছি। কারণ এখানে যে ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে কেন্দ্রে আমাদের পোলিং এজেন্টদের দেওয়া ফলাফলের সঙ্গে মিলছে না। তখন রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ১৩২টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেন তিনি। ফলাফল ঘোষণার পর লিখিত অনুলিপির জন্য প্রায় আধা ঘন্টা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে অবস্থান করেন আরিফুল হক চৌধুরী। এ সময় তার সমর্থকরা স্লোগান ধরেন। রাত সোয়া ১২টার দিকে নেতাকর্মীদের নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় ত্যাগ করেন আরিফুল হক চৌধুরী। রিটার্নিং কর্মকর্তা জানান, মোট ১ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৬ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। বাতিল হয়েছে ৭ হাজার ৩৬৭টি ভোট। এরপর আলীমুজ্জামান সব মেয়র প্রার্থীর ভোট সংখ্যা জানিয়ে দুটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিতের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী এখন ওই দুই কেন্দ্রে নতুন ভাবে ভোটগ্রহণের নির্দেশ দেবে নির্বাচন কমিশন। শীর্ষ দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান স্থগিত কেন্দ্র দুটির মোট সংখ্যার চেয়ে কম বলে ফল ঘোষণা না করার কথা জানান তিনি। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের গাজী বোরহান উদ্দিন (রহ.) মাদ্রাসা (১১৬ নং কেন্দ্র) ও ২৭ নং ওয়ার্ডের হবিনন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৩৪ নং কেন্দ্র) কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। গাজী সৈয়দ বোরহান উদ্দিন (রহ.) মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ২২১ জন ও হবিনন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ৫৬৬ জন। সিলেটে মোট ভোটার ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৪৪ জন এবং নারী ১ লাখ ৫০ হাজার ২৮৮ জন। একজন মেয়র, ২৭ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ৯ জন নারী কাউন্সিলর নির্বাচনে ভোট দেন ভোটাররা। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের যাত্রা শুরু হয় ২০০২ সালে। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কামরানকে প্রায় ৩৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র হন বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী। সেবার ভোট পড়েছিল ৬২%। ২০০৮ সালে ভোটে জিতে কামরান মেয়র নির্বাচিত হয়ে পরের বার হেরেছিলেন। এবার নিয়ে টানা তিনবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন তিনি। বরিশাল ও রাজশাহীর সঙ্গে গত সোমবার সিলেট সিটিতেও একযোগে ভোটগ্রহণ হয়। রাজশাহীতে কোনো কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হয়নি। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। বরিশালে ১৫টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় তার জয় নিশ্চিত হয়।