মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ডিজিটাল প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে গ্রাহকের হাজার হাজার টাকা। প্রযুক্তিগত সুবিধার অপব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের প্রতারিত করতে গড়ে উঠেছে বিশাল প্রতারক চক্র। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ওই চক্রের সঙ্গে জড়িত ৩৭৪ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশে গড়ে প্রতিদিন অন্তত দুটি করে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণার অভিযোগ জমা পড়ছে। বর্তমানে ওই ধরনের মামলার সংখ্যা রয়েছে ২২৫টি। নিরক্ষর ব্যক্তিরা মোবাইল ব্যাংকিং বেশি ব্যবহার করলেও প্রতারিতদের প্রায় সবাই শিক্ষিত গ্রাহক। ভুক্তভোগী ও ব্যাংকিং খাত এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ ঘটনার পাশাপাশি অপরাধ কর্মকান্ডের অর্থও লেনদেন হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত এজেন্টের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে। সেজন্য বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ২৭ জন এজেন্টও গ্রেফতার হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ লেনদেন ও মুত্রা পাচারের অভিযোগে মামলা হয়েছে। ঢাকা বিভাগে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক। দেশের মোট গ্রাহকের ২৪ শতাংশই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা। ১৮ শতাংশ গ্রাহক নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম বিভাগ। বাকি গ্রাহক দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দা। ঢাকা বিভাগেই মোবাইল ব্যাংকিং সবচেয়ে বেশি প্রতারণা হয়। আর প্রতারণার সঙ্গে জড়িতদের বড় অংশই ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও কুমিল্লার বাসিন্দা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যানুযায়ী অপরাধীরা অর্থ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে মোবাইল ব্যাংকিং। ১৫ ধরনের অপরাধ কর্মকাÐের অর্থ লেনদেনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার চিহ্নিত করা হয়েছে। মাদক ব্যবসা, মানবপাচার, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, হত্যা, অপহরণ, হুন্ডি, জালিয়াতি, জিনের বাদশা, হ্যালো পার্টি, প্রতারণা, মুক্তিপণ আদায়, প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রবাসীদের জিম্মি করে টাকা আদায় ও ধর্মভিত্তিক জঙ্গি কর্মকাÐের মতো অপরাধের ঘটনায় টাকা লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং। সূত্র জানায়, দ্রæততম সময়ে এক স্থান হতে অন্য স্থানে টাকা পাঠানোর অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম এখন মোবাইল ব্যাংকিং। বর্তমানে এ সেবা ব্যবহার করেই মানুষ তাদের পরিবার পরিজন ও নিকটাত্মীয়ের কাছে বেশি টাকা পাঠাচ্ছে। তাছাড়া এ সেবার মাধ্যমে রেমিটেন্সের অর্থ প্রেরণ, বেতনÑভাতা ও ইউটিলিটি বিল পরিশোধ সবই উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ছে। মূলত ব্যাংকে গিয়ে অর্থ আদান-প্রদানের ঝামেলা এড়াতে প্রতিদিনই বাড়ছে বিভিন্ন ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার গ্রাহক। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতারণা। গড়ে উঠছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট চক্র। থামানো যাচ্ছে না গ্রাহক হয়রানি। এক হিসাবে দেখা গেছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১ হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকার লেনদেনই বেশি। সাধারণত যারা অল্প আয়ের মানুষ এবং যারা ব্যাংকে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলার মতো দক্ষ নন, তাদের একটি বড় অংশ এ ব্যাংকিং সেবার দিকে ঝুঁকছে। তাতে একবারে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা লেনদেন করা যায়। তবে কেউ চাইলে একাধিক এজেন্ট বা এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আরো অনেক বেশি টাকা লেনদেন করতে পারে। তবে ওই লেনদেনের তেমন কোন তথ্য থাকে না। এজেন্টের মাধ্যমে করলে যার কাছে টাকা পাঠানো হয়, তার মোবাইল নম্বর ছাড়া আর কোন তথ্যই থাকে না। আর সেটার সুযোগ নিয়েই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ কাজে টাকা ব্যবহার হচ্ছে। ভুয়া মেসেজের মাধ্যমে এজেন্টরা যেমন টাকা দিয়ে প্রতারিত হচ্ছে, তেমনি গ্রাহকের টাকাও তুলে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে ভ‚রি ভ‚রি। সূত্র আরো জানায়, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করতে প্রতারকচক্র সবসময়ই তৎপর থাকে। আর হুন্ডি, মাদক ও চোরাচালানের অর্থ লেনদেনে জড়িত রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টরা। বিগত ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বিকাশ, রকেটসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত ২ হাজার ৮৮৮ জন এজেন্টের একটি তালিকা সিআইডির কাছে পাঠায়। তাদের অস্বাভাবিক লেনদেন খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করে বিএফআইইউ। সেখান থেকে সিআইডি অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনকারী ২৫ বিকাশ এজেন্টকে চিহ্নিত করে। পরে তাদের গ্রেফতার করতে অভিযানও চালায় সিআইডি। গতবছরের জানুয়ারিতে সিআইডির অভিযানে গ্রেফতার হয় ১১ জন এজেন্ট। সিআইডি ছাড়াও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে বিভিন্ন সময় আরো ১৬ জন এজেন্ট গ্রেফতার হয়। ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগে রাজধানীর ডেমরা থেকে বিকাশের ৩ এজেন্ট গ্রেফতারের ঘটনা ছিল আলোচিত। গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে ৩০০ মোবাইল সিম, ৯০০ ছবি ও ৮৫০টি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িতরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অর্থ লেনদেন করতো বলে সেসময় জানিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ। সূত্র আরো জানায়, তুলনামূলকভাবে যারা অসচেতন তাদের ভুল বুঝিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অন্যের টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য বড় ধরনের সিন্ডিকেট চক্র সক্রিয় রয়েছে। অত্যন্ত সূ² ও দক্ষ কায়দায় তারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের টাকা লুটে নিচ্ছে। তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন অবসরে যাওয়া সরকারী চাকরিজীবী, সেনা কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের সদস্যরা পর্যন্ত। এদিকে এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, লোভ বা সুযোগের কথা বলে প্রতারকরা গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অধিকাংশ গ্রাহকই সঠিকভাবে মোবাইল ব্যাংকিং বোঝে না। তাছাড়া নিয়মানুযায়ী টাকা লেনদেন করছে না মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরা। তারা গ্রাহকদের তথ্য সংরক্ষণেও সচেতন না। এজেন্টদের কাছ থেকেই মূলত গ্রাহকের নম্বর সংগ্রহ করে প্রতারকরা। অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জানান, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে গ্রাহকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেনের প্রতিটি পর্যায়ে রেকর্ড থাকে। ফলে সেক্ষেত্রে অনিয়ম কিংবা সন্দেহজনক লেনদেনের ঝুঁকি নেই। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে যাচাইয়ের মাধ্যমে সিমকার্ড নিবন্ধন করার কারণে এ্যাকাউন্টধারী গ্রাহকের পরিচয় নিশ্চিত করাও সহজ হয়েছে। কিন্তু এজেন্টের মাধ্যমেই অনিয়মের ঝুঁকি এবং সন্দেহজনক কিংবা অনিয়মের মাধ্যমে লেনদেনের ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এজেন্টদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও নিজস্ব নিয়মে নজর রাখছে। অনিয়ম পাওয়া গেলে এজেন্টের নিবন্ধন বাতিল করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিকাশের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম জানান, বিকাশ সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করছে। প্রতারণা থেকে বাঁচতে বিকাশ কর্তৃপক্ষ ৪টি সতর্কতামূলক বার্তা দিচ্ছে। এসব অনুসরণ করলে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। ১. নিজের বিকাশ এ্যাকাউন্টের পিন নম্বর ও অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স কখনও কাউকে বলবেন না। ২. ফোনে কেউ যদি আপনাকে ভুল করে টাকা পাঠানোর কথা বলে ফেরত চায় সন্দেহ হলে অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স চেক করুন। ৩. কারো প্ররোচনায় লটারি জেতার মিথ্যা আশায় কোনো লেনদেন করবেন না। ৪. ফোনে শুধু কারো কথা শুনে পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কারো নির্দেশনায় কোন নম্বর ডায়াল করবেন না বা টাকা পাঠাবেন না।