গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় শীতকালীন সবজি দেশি লাউ চাষ করেছে কৃষকরা। শীতকালীন সবজির মধ্যে অন্যতম সবজি হলো দেশি লাউ। শীতকালে লাউয়ের ফলন বেশি হয়। লাউ গাছ উচ্চতাপ ও অতিবৃষ্টি সহিষ্ণু ফলে বার মাসই আবাদ করা যায়। বাংলাদেশের যে কোন এলাকায় সারা বছরই এর চাষ করা যায়। শীতকালীন চাষের জন্য ভাদ্রের প্রথমে আগাম ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। বাজারে দেশি লাউয়ের ব্যপক চাহিদা রয়েছে। বাজার মূল্য ভাল পাওয়ায় লাভবান কৃষক। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস ও কৃষক সূত্রে জানা যায়, কালিয়াকৈর উপজেলায় মোট কৃষি জমি ২৩ হাজার ৯৫৪ হেক্টর। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৫৫০ হেকক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি আবাদ করা হয়েছে। সবজি দেশি লাউ, বেগুন, সীম, টমেটো, ফুলকপি, বাধাকপি আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে এ বছর প্রায় ৪৫০ হেক্টর জমিতে লাউ চাষ করা হয়েছে। এ বছর শীতকালীন শাক-সবজির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি অর্জন হয়েছে। উপজেলায় এবার সবচেয়ে বেশি দেশি লাউ চাষ করা হয়েছে। কারণ লাউ চাষে অল্প খরচে অধিক ফলন পাওয়া যায়। লাউ চাষ হয় মাচা বা টালে (স্থানীয় ভাষায় জাঙ্গলাও বলা হয়ে থাকে)। ভাদ্র-আশ^ীন মাসে মাটিতে মাদা তৈরী করে লাউ বীজ পুতে রাখার উত্তম সময়। তবে দুই ভাবে বীজ রোপন করা যায়। প্রথমটি জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ এঁটেল দো-আঁশ মাটি একটি পলিথিনের মধ্যে ভরে তাতে বীজ বপন করা যায়। পলিথিনে চারা গজালে মাচার নিচে সারি করে বপন করা যায়। আবার সরাসরি মাচার নিচে কিছু দূর পরপর লাইন করে মাদা তৈরী করে তাতে সরাসরি বীজ বপন করা যায়। বীজ অঙ্কুরোদগম হতে ৮-১০দিন সময় লাগে। চারা গজানোর ১৫-২০ দিনের মধ্যে চারা লাগানোর উত্তম সময়। এর মধ্যে মাচা তৈরী করে নিতে হয়। মাচা তৈরী করতে বাঁশ ও দড়ির প্রয়োজন হয়। বাঁশের খুঁটি মাটিতে থাকলে ওই পোকায় খেয়ে ফেলে। তাই অনেক কৃষকই বাঁশের পরিবর্তে সিমেন্টর খুটি ব্যবহার করে। সিমেন্টর খুটি মাটিতে পুতে তার উপরের অংশের সাথে বাঁশ রেখে দড়ি দিয়ে বেঁধে মাচা তৈরী করা হয়। সিমেন্টর খুটি ও বাঁশ দিয়ে মাচা তৈরীর ফলে টেকসই হয়। ফলে কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়। বপনের কয়েক দিনের মধ্যে চারা গাছ গুলো মাচায় উঠে যায়। এর ৫০-৬০দিনের মধ্যে ফলন পাওয়া শুরু হয়। সময় মত লাউ গাছের ভাল যতœ নিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। এ লাউ চাষ করতে তেমন খরচ হয়না। বিঘা প্রতি সার,ভিটামিন ও মাচাসহ ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়। লাউ গাছে রোগ বালাই কম ও পোকা মাকড় তেমন ক্ষতি করতে পারে না। প্রতি বিঘায় ১০-১২ হাজার টাকা খরচ করে প্রতিবার ১ লক্ষ টাকার লাউ বিক্রয় করা সম্ভব। একটি দেশি লাউ বাজারে বিক্রি হয় ৩৫-৮০ টাকা পর্যন্ত। টানা ৩ মাস ফসল তোলা যায়। একটি গাছ থেকে গড়ে ২০-২৫টি লাউ পাওয়া যায়। লাউ গাছের জীবন কাল ৪-৫ মাস। ফলন পাওয়ার শেষে আবার লাউ গাছ কেটে লাউ পাতা শাক হিসেবে বিক্রি করা হয়। এতে বিঘা প্রতি প্রায় ২০-২৫ হাজার টাকার মতো বিক্রি করা যায়। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কালিয়াকৈর উপজেলার আষাড়িয়া বাড়ী কৃষি মাঠে কৃষক মোহাম্মদ আলী ৯৩ শতাংশ লাউ ক্ষেত চাষ করেছে। পাশেই ৫০ শতাংশের আরেকটি মাচা মহসীন আলীর। ৫০ শতাংশের আরেকটি মাচা মো. রহিজ উদ্দিন মন্ডলের। মাচায় কচি কচি সবুজ রঙ্গের ছোট বড় লাউ ঝুলে আছে। বিক্রয়ের উপযুক্ত একেকটি লাউয়ের ওজন প্রায় ২-৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। একই উপজেলার বড়ই বাড়ী এলাকার কৃষক রিপন মৃধা কুন্দাঘাটার কৃষি মাঠে ৪০ শতাংশ জমিতে দেশি লাউ চাষ করেছে। কালিয়াদহ কৃষি মাঠে মাঠেও মাচায় লাউ ঝুলছে। একই রকম উপজেলায় আরও কয়েকশ হেক্টর জমিতে লাউয়ের চাষ করেছে কৃষক। কালিয়াকৈর উপজেলার আষাড়িয়া বাড়ী এলাকার কৃষক মোহাম্মদ আলী, রহিজ উদ্দিন, মহসীন আলী ও খলিল জানান, ফসলি জমি ধ্বংশ করে মাটি কেটে নিয়ে ফেলেছে ইটের ভাটায়। এতে ধান ক্ষেতের সেচ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়াতে বোরো আবাদ বন্ধ হয়ে যায়। জমি পতিত থাকায় বাধ্য হয়েই লাউ চাষ শুরু করেছি। তবে এ বছর বন্যার পানি দেরীতে নেমে যাওয়ায় ও নামার পরে পানি বেড়ে যাওয়াতে প্রথম বারের লাউয়ের চারা পঁচে গেছে। এ কারণে দ্বিতীয় বার একটু দেরিতে চারা রোপন করা হয়েছে। লাউ চাষের উপযুক্ত সময় হলো ভাদ্র-আশ^ীন মাস। আবার এ বছরের শীতের তাপমাত্রা নিচে নামায় লাউ গাছের ক্ষতি হয়েছে। এবার ফলন একটু দেরীতে পেয়েছি। সব ক্ষতি পুষিয়ে কিভাবে ভাল ফলন পাওয়া যায়, এই জন্য কালিয়াকৈর উপজেলা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খানের পরামর্শ নিয়েছি। কর্মকর্তার পরামর্শে ভালই ফল পাইতেছি। বর্তমানে বাজারে একটি লাউ বিক্রি করা যায় ৩৫-৮০ টাকা। লাউয়ের বাজার মূল্য ভাল হওয়াতে আশা করছি বিঘা প্রতি একলক্ষ টাকা বিক্রি করতে পারব। আবার লাউ বিক্রি শেষে বিঘা প্রতি ২০-২৫ হাজার টাকার লাউ শাক বিক্রি করতে পারব। আরও মাস খানেক লাউ বাজারে তুলতে পারব। লাউ চাষে তেমন কোন বাড়তি খরচ নেই। প্রথমবার মাচা তৈরী করতে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আবার এই মাচায় কয়েকটি ফসল তুলা যাবে। যেমন, এই লাউ শেষ হবার সাথে সাথেই বা জালি কুমড়ার চারা মাচায় তুলে দেওয়া হবে। আবার এর সাথে সাথী ফসলও চাষ করা যাবে। এ বছর বারী-১ ও ২ এবং হাইব্রিড ডায়না এই জাতের লাউ চাষ করেছি। তবে ভাদ্র মাসের শুরুতে চারা রোপন করতে পারলে আগাম ফলন পাওয়া যেত। যাই হোক বোরো আবাদের চেয়ে এখন লাউ বিক্রি করে ভালই লাভবান। কালিয়াকৈর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খান জানান, আমাদের এই দেশ কৃষি স্ব-নির্ভর দেশ। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে কৃষকদের মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন সময় পরামর্শ দিয়ে থাকি। তার মধ্যে বিভিন্ন সময় লাভজনক শাক-সবজি আবাদ করার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়ে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছর শীতকালীন সবজির মধ্যে বেশি দেশি লাউ চাষ করেছে কৃষক। লাউ বার মাসই চাষ করা যায়। তবে লাউ প্রধানত শীত মৌসুমের অন্যতম ফসল। শীতকালে দেশি লাউয়ের ফলন বেশি হয়। দেশি লাউ হিসেবে স্বাদ ও পুষ্টিমানেও কমনয়। একটি দেশি লাউয়ের ১৭ ধরনের এ্যামাইনো এসিড, রাইবোফ্লাভিন, ভিটামিন সি, থায়ামিন, জিঙ্ক, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ এবং ৯৬% পানি রয়েছে। এতে ফ্যাট ও কোলস্টেরল নেই বললেই চলে। আবার লাউ শাক ফলিক এসিড সমুদ্ধ খাবার। লাউ শাকে রয়েছে উচ্চ মাত্রার ভিটামিন-সি, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, বেটা-ক্যারোটিন, লুটেইন এবং জিয়েজ্যান্থিন। লাউ শাকে ক্যালরি কম এবং ফ্যাট ও কোলস্টেরল মুক্ত। এ বছর উপজেলায় বারী- ১ ও ২ এবং হাইব্রিড ডায়না এ দুই জাতের লাউ চাষ করা হয়েছে। লাউ চাষে তেমন কোন বাড়তি খরচ নেই। কৃষকের পরিশ্রমও কম হয়। অল্প খরচেই অধিক ফসল পাওয়া যায়। আবার রোগ বালাইয়ের প্রকোপও কম। লাউ গাছের কয়েকটি রোগে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে ছত্রাকের আক্রমন, পাতা পোড়া, নেতিয়ে পড়া/ঢলে পড়া,পাতায় পাউডার। এর প্রতিকারও খুব সহজ ও কম খরচেই হয়ে যায়। লাউ গাছে ছত্রাক আক্রমন করলে ১০ লিটার পানির সাথে মাত্র ৬ গ্রাম নাটিভো পাউডার বা রিডোমিল মিশিয়ে স্প্রে করলেই ছত্রাকের আক্রমন রোধ করা যায়। আবার বোরণ,সালফার সার ও ভিটামিনের সাথেও কীটনাশক মিশিয়ে স্প্রে করা যায়। তবে রোগাক্রান্ত হওয়ার আগেই স্প্রে করলে ভাল হয়। শাক-সবজীর বড় একটি যোগান দিচ্ছে দেশি লাউ ও লাউ শাক। দেশি লাউ চাষ করে নিজেদের বাজারের চাহিদা মিটিয়ে, পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌছে দিচ্ছে কৃষক। আবার লাউ তুলা শেষে লাউ গাছ কেটে পাতা শাক হিসেবে বাজারে বিক্রি করা হয়। অল্প খরচে অধিক ফলন এবং ভাল দাম পাওয়ায় লাউ চাষে লাভবান কৃষক।