হাওরে গতবারের আগেরবার ছিল হাফ কষ্টের বছর, আর গেল বছর কষ্ট ফুলমার্ক পেয়ে পাস করেছে। এ বছর কষ্টের জিপিএ-৫। কখনো ম্যারাথন দৌড়ের চেয়ে দীর্ঘতর মনে হয় এই কষ্টের দৈর্ঘ্য। ঘরে খোরাক না থাকলে দম থাকে না। হাওরের রসিক মানুষ গাইন সুন্নাত ওলী বলেন, ঋণের কলের থেকে ধারে নেওয়া দম ক্ষণেক থাকে ক্ষণেক যায়! ক্ষুধা কি মানুষকে মরমি করে দার্শনিক বানায়? বেশি বা কম চড়া সুদের সব ঋণের শর্ত ছিল, বৈশাখেই টাকা শোধ করতে হবে। এখন আর কেউ ঋণের কিস্তি ধানে ফেরত নেয় না। ধান নাও বা টাকা নাও, ফেরত হবে নগদা নগদ টাকায়। এবার ধান কাটার শ্রমিক বা কামলারাও নগদ টাকা ছাড়া কাজে হাত লাগাননি। অনেক ক্ষেত্রে লেবার কনট্রাকটরদের (দালাল) আগাম টাকা দিয়ে শ্রমিক সংগ্রহে পাঠাতে হয়েছে, ধারের ওপর ধার করতে হয়েছে আশার দমটা টিকিয়ে রাখার জন্য। পোকা-ভাইরাসে কিছু ধান মার খেলেও মোটের ওপর ফসল বেঁচে গেছে। কৃষকের ধান মাঠ থেকে খলায় এনে মাড়াই করে ধানের ভাগ নিয়ে যারা এতদিন ভাগালু হিসেবে পরিচিত হয়েছে, হাওরের শ্রম কেনাবেচার একটা বাজার-সহনীয় প্রথা তৈরি করেছে তারা। এবার প্রথা ভাঙতে বাধ্য হয়েছে, যোগাযোগব্যবস্থার চরম অবনতি, পাড়ানির (যাতায়াত) খরচ এখন আয়ত্তের বাইরে। ট্রাকে ধান নিয়ে সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, জামালপুর ফিরতে বছর দুই আগে যা খরচ আর সময় লাগত, এখন লাগে তার প্রায় তিন গুণÑআর সময়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া ধানের বাজারদর যেন ২০১০-১১ সালের শেয়ারবাজার, দর পড়ছে তো পড়ছেই।
কেন পড়ছে ধানের দাম? সংবাদকর্মীদের সঙ্গে ধানের দরপতনের কারণ নিয়ে আলোচনার সময় চাঁদপুরের মিলমালিক নকিব চৌধুরী সঠিকভাবেই বলেছেন, ‘বাজারে প্রচুর আমদানি করা চাল রয়েছে। আমাদের চালের চাহিদা নেই। এজন্য আমরা ধান কিনছি না। গত বছর বন্যা আর ফসলহানির কারণে ‘যেখানে পাও, যা পাও’ নীতির ভিত্তিতে চাল আমদানির নীতিমালা শিথিল হওয়ায় আমদানি চালের মজুত নিশ্চয় বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র দিয়ে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, তিন মাসে চাল আমদানির এলসি বেড়েছে ১৮৫ গুণ; এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮৫ গুণ বা ১৮৩৯২ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে চাল আমদানির জন্য মাত্র ৫০ লাখ ৩০ হাজার ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। দুই দফা বন্যায় খাদ্যসংকট এড়াতে সরকার শুল্ক কমিয়ে আনার পর চাল আমদানি বেড়েই চলেছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়েই চাল আমদানি বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত মঙ্গলবার আমদানি-সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ১ হাজার ৪৭০ কোটি ৩১ লাখ (১৪.৭০ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে চাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৩২ কোটি ৯১ লাখ ডলারের, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯০৬৩ শতাংশ বেশি। আমদানির লাগাম সময় মতো টানতে না পারায় কৃষকেরা পড়েছেন ফাঁপরে! এ ছাড়া কৃষকের ধান ধরে রাখার ক্ষমতা এ বছরে একেবারেই নেই, ধার আর কিস্তির টাকা তাঁকে জ্যৈষ্ঠের আগেই পরিশোধ করতে হবে। গত দুই বছর ফসল মার যাওয়ায় হাওরের ঘরদোর মেরামত করা সম্ভব হয়নি, এবার বর্ষার আগেই সেটা করতে হবে, নইলে আসন্ন আফালে (হাওরের ঢেউ) ভিটাবাড়ি টেকানো কঠিন হবে। কাজেই ধান না বেচে তাঁর উপায় নেই। গত সপ্তাহে সংবাদকর্মীরা কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার প্রধান পাইকারি বাজার চামড়া নৌবন্দরসহ বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দেখেছেন, নতুন বোরো হাইব্রিড মোটা ধান প্রতি মণ ৫৫০ টাকা, ব্রি-২৯ ৬৩০ ও ব্রি-২৮ ধান ৬৫০ টাকা মণে কেনা বেচা হচ্ছে। অথচ এক মণ ধান উৎপাদন করতে কৃষকদের কম করে হলেও ৭০০ টাকা খরচ হয়েছে। পাইকারি বাজারে হাল যদি এমন হয়, তাহলে যাঁরা খলায় ধান মাড়াইয়ের পরপরই ধান বিক্রি করতে চান, তাঁরা কেমন দাম পাচ্ছেন? হাটের থেকে মণপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা কম। এই সুযোগে আশপাশের ধানকলের মালিকেরা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে খেওয়ালদের (মিলমালিকের প্রতিনিধি, যাঁরা ধান মেপে খলা থেকে কিনে নেন নগদে) পাঠিয়ে দিয়েছেন খলায় খলায়। কবে ধান কিনবে সরকার? গত ৮ এপ্রিল চলতি বছরে কৃষকদের কাছ থেকে ৩৮ টাকা কেজিতে চাল ও ২৬ টাকা কেজিতে ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। অর্থ, বাণিজ্য আর খাদ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এই বৈঠকে বোরো আতপ চাল কেজিপ্রতি ৩৭ টাকা দরে কেনার সিদ্ধান্ত হয়; ২ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান-চাল কেনার কথা। তবে ১২ মে এই লেখার সময় পর্যন্ত চাল দূরে থাক, ধান কেনার কোনো পাঁয়তারা কোথাও চোখে পড়েনি। তা ছাড়া নয় লাখ মেট্রিক টনের মধ্যে মাত্র এক লাখ মেট্রিক টন থাকবে আতপ চাল। হাওরে সবই আতপ চাল, তার মানে হাওরের হিস্যা মাত্র এক লাখ টন। ধান কেনা হবে দেড় লাখ মেট্রিক টন। তবে তার কতটা হাওরের, সেটাও ফরসা করা প্রয়োজন। ধানে শিকড় গজানোর আগেই সরকারের ঘুম কাটুক।