দেশের প্রধান দুই খাদ্যশস্য ধান ও গমের আবাদ কমে গেছে। এক বছরের ব্যবধানে ওই দুটি শস্যের আবাদ প্রায় ১০ লাখ একর কমেছে। ধানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে বোরোর আবাদ। দেশের প্রধান দুই দানাদার খাদ্যশস্য ধান ও গমের আবাদ এক বছরে প্রায় ১০ লাখ ১৩ হাজার একর কমেছে। ধানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে বোরোর আবাদ। বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছে দেশে বোরোর আবাদ কমেছে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ। আর গমের আবাদ কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। সম্মিলিতভাবে ধান ও গমের আবাদ প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ কমলেও বেড়েছে পাট, ভুট্টা, আলু ও সরিষার আবাদ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ১ কোটি ১৭ লাখ ৯৪ হাজার একর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছিল। কিন্তু পরের অর্থবছর বোরোর আবাদ নেমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৩৪ হাজার একর। তাছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৫ লাখ ১৬ হাজার একর জমিতে আউশের আবাদ হলেও পরের অর্থবছর তা ১ লাখ ৮৯ হাজার একর কমেছে। তবে আমন ধানের আবাদ খুব বেশি কমেনি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ কোটি ৩৮ লাখ ১৪ হাজার একর জমিতে আমন ধান আবাদ হয়েছিল, পরের অর্থবছর তার চেয়ে ১৭ হাজার একর কমেছে। ওই এক বছরে গমের আবাদ কমেছে ৭৩ হাজার একর। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০ লাখ ৯৯ হাজার একর গমের আবাদ হলেও পরের অর্থবছর তা আবাদ হয় ১০ লাখ ২৬ হাজার একর। মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উন্নত জাতের অভাব ও শস্যের যৌক্তিক দাম না পাওয়ায় ধানের আবাদ ছাড়ছেন কৃষকরা। আর শীতপ্রধান ফসল গমের আবাদ কমছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শীতের দীর্ঘস্থায়িত্ব কমে যাওয়ায়। সূত্র জানায়, প্রতিটি শস্য আবাদ কমার পেছনে আলাদা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে একটি কারণ হলো, কৃষকরা আর্থিক লাভ বিবেচনায় একটি ফসল ছেড়ে আরেকটি ফসলে স্থানান্তরিত হয়ে থাকেন। তারা ওই ফসলই আবাদ করবেন, যেটি তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি লাভজনক মনে হবে। আগাম বন্যার কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাপক পরিমাণে বোরো ধানের আবাদ কমেছে। তাছাড়া আউশ ধানে ফলন ভালো না পাওয়ায় অন্য ফসল আবাদ বেশি লাভজনক মনে করছে কৃষক। যে কারণে আউশের আবাদ কমেছে। আগামী দিনে আমন ধানের আবাদ খুব বেশি না কমলেও গমের আবাদ ধরে রাখাটা চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শীতকালের স্থায়িত্ব অনেক কমে এসেছে, যার কারণে গম আবাদ করে কৃষক ভালো ফলন পাচ্ছে না। এমন অবস্থায় গমের মৌসুমে বিকল্প শস্য আবাদে কৃষককে উৎসাহিত করা জরুরি। সূত্র আরো জানায়, আবাদ কমার পাশাপাশি ধান ও গমের সার্বিকভাবে উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ধানের মোট উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৪৭ লাখ টন, যা পরের অর্থবছরে কমে হয়েছে ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন। আর গমের উৎপাদন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৪৮ হাজার টন হলেও পরের অর্থবছর তা কমে ১৩ লাখ ১১ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন কমার ফলে আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে। সদ্য বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চাল ও গমের রেকর্ড ৯৯ লাখ ৯১ হাজার টন আমদানি হয়েছে। তার মধ্যে ৪১ লাখ ১৬ হাজার টন চাল ও ৫৮ লাখ ৭৫ হাজার টন গম আমদানি করতে হয়েছে। এদিকে দেশে ধান ও গমের আবাদ কমলেও বেশকিছু শস্যেন আবাদ বাড়ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিভিন্ন শস্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পাট ও ভুট্টার আবাদ। তার মধ্যে পাটের আবাদ ১৬ লাখ ৭৫ হাজার একর থেকে ১ লাখ ৪৮ হাজার একর বৃদ্ধি পেয়েছে। আবাদ বৃদ্ধির কারণে উৎপাদনও ৭৫ লাখ ৫৯ হাজার বেল থেকে ৮২ লাখ ৪৭ হাজার বেলে উন্নীত হয়েছে। আর ভুট্টার আবাদ ৮ লাখ ২৮ হাজার একর থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার একর বৃদ্ধি পেয়েছে। শস্যটির আবাদ বাড়ার কারণে উৎপাদনেও বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে। ২৪ লাখ ৪৫ হাজার টন থেকে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ২৬ হাজার টনে। তাছাড়া আলুর আবাদ ১১ লাখ ৭৫ হাজার একর থেকে পরের অর্থবছরে ৬০ হাজার একর বৃদ্ধি পেয়েছে। সরিষার আবাদ ৭ লাখ ৮৭ হাজার একর থেকে ৪৪ হাজার একর বেড়েছে। একইভাবে সয়াবিনের আবাদ বেড়েছে ৩১ হাজার একর, সবজির ২৯ হাজার, ফলের ১৯ হাজার, রসুনের ১৪ হাজার, মরিচ ও পেয়াজের আবাদ ৪ হাজার একর করে বেড়েছে। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন জানান, সার্বিকভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ভারসাম্য আনা হচ্ছে। চাল উৎপাদনে দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বোরো ধানের আবাদ বেশ কিছুটা ক্ষতির শিকার হয়। তবে পরের অর্থবছরে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। গত অর্থবছরে বোরোতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আবাদ ও উৎপাদন কম হয়েছে। অন্যদিকে আউশ ধানের নানাবিধ সুবিধা বিবেচনা করে আবাদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেজন্য কৃষককে আর্থিক প্রণোদনা ও উপকরণসহায়তা দেয়া হচ্ছে। তারও সুফল পাওয়া যাবে। তবে গমের ক্ষেত্রে আবহাওয়াগত ঝুঁকি রয়েছে। কারণ গমের জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় তাপমাত্রার পাশাপাশি শীতেরও প্রয়োজন হয়। সেজন্য শস্যটি আবাদের বিকল্প হিসেবে ভুট্টাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। আগামী দিনে ভুট্টার উৎপাদন কোটি টনে উন্নীত করারও পরিকল্পনা রয়েছে।