ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর নলকূপে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক
তারিথ
: ২৯-০৯-২০১৮
অনলাইন ডেস্ক :
কৃষিজমিতে সেচের জন্য অগভীর নলকূপ বা শ্যালো টিউবওয়েলে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক। কারণ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর নলকূপে আশানুরূপ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ জমি সেচে একসময় জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল অগভীর নলকূপ বা শ্যালো টিউবওয়েল। কিন্তু ৪ বছওে ওই সেচ যন্ত্রটির ব্যবহার কমেছে প্রায় সোয়া এক লাখ। একই সাথে শ্যালো পাম্পে সেচের আওতায় জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৪ লাখ একর। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সেচকাজে দেশব্যাপী বারিড পাইপ ও গভীর নলকূপের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে শ্যালো পাম্পের ব্যবহার কমেছে। একটি গভীর নলকূপ ১২-১৫টি শ্যালো পাম্পের কাজ করতে পারে। পাশাপাশি সেচে এখন ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহারও বেড়েছে। আবার অনেক অঞ্চলের পানির স্থর এতো নিচে নেমে গেছে, সেখানে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি ওঠানো যাচ্ছে না। শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে ভূগর্ভের ২০-২২ ফুট নিচের পানি উত্তোলন সম্ভব হলেও উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলায় এখন পানির স্তর এর চেয়ে নিচে নেমে গেছে। ফলে ওসব অঞ্চলেও শ্যালোর ব্যবহার কমে যাচ্ছে। বিগত ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে মোট শ্যালো টিউবওয়েলের ব্যবহার ছিল ১৫ লাখ ২৩ হাজার ৬০৯টি। পরের অর্থবছরে তার ব্যবহার বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ লাখ ৬৩ হাজার ৭৯১টি। কিন্তু তারপর থেকে যন্ত্রটির ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৭১১, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৪ লাখ ১৭ হাজার ৮ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৯৬০টিতে দাঁড়ায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যবহৃত শ্যালো টিউবওয়েলের মধ্যে ১১ লাখ ১২ হাজার ১৬টি ছিল ডিজেলেচালিত এবং ২ লাখ ৮৬ হাজার ৯৪৪টি ছিল বিদ্যুৎচালিত। সূত্র জানায়, বিগত ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশের প্রায় ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমিতে শ্যালো পাম্পের মাধ্যমে সেচ দেয়া হলেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জমির পরিমাণ কমে ৩০ লাখ ৭৯ হাজার ১ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ৪ বছরের ব্যবধানে শ্যালো পাম্পের আওতায় জমির পরিমাণ কমেছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৪৩৯ হেক্টর বা প্রায় ৪ লাখ একর। তবে কৃষিসংশ্লিষ্টরা সেচ কার্যক্রমে শ্যালো টিউবওয়েলের ব্যবহার কমার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। কারণ তাতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমার পাশাপাশি মাটির নিচে পানির স্তরে ভারসাম্য আনতে ভূমিকা রাখছে। মূলত প্রয়োজনের তাগিদ ও বিকল্প যন্ত্র না থাকার কারণেই দেশে একসময় শ্যালো পাম্পের ব্যবহার বেড়েছিল। তাতে কৃষকের পানির চাহিদা মেটালেও শ্যালোতে তুলনামূলক বেশি খরচ ও বেশি বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এখন বিকল্প যন্ত্র বিশেষ করে বারিড পাইপের ব্যবহার বেড়েছে। তাছাড়া নদী-নালা, খাল-বিল কিংবা বিভিন্ন ধরনের ভূ-উপরিস্থ পানির উৎসগুলোকে এখন কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে সামনের দিনে শ্যালোর ব্যবহার আরো কমে যেতে পারে। সূত্র আরো জানায়, সেচের পানির সর্বোত্তম ব্যবহারে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সেচের পানির অদক্ষ ব্যবহারে পরিবেশ বিপর্যয়ের হুমকি তৈরি হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ-জ্বালানিরও অপব্যবহার হচ্ছে। বিএডিসি ভূগর্ভস্থ পানির জোনিং চিত্র বলছে, সেচ মৌসুমে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় দেশের পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বের ৩১ জেলায় পানির স্তর প্রতি বছর ৪ ইঞ্চি থেকে দেড় ফুট নিচে নামছে। তাতে কৃষকের সেচের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি হেক্টর জমিতে বোরো আবাদে ১৫ বছর আগেও যেখানে খরচ ছিল ৫ হাজার টাকা। এখন তা ১০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। জ্বালানি খরচসহ অন্যান্য উপকরণ ব্যয় স্থির থাকলে ২০৩০ সালে প্রতি হেক্টর জমিতে সেচ খরচ ১৭ হাজার টাকা ছাড়াবে বলে শঙ্কা রয়েছে। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণে সাশ্রয়ী পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই। এদিকে দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক কোটি হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়। তার মধ্যে বোরো আবাদ হয় ৪৭-৪৮ লাখ হেক্টরে। আর বোরো আবাদেই সেচের প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি। তার বাইরে গম, ভুট্টা, কিছু সবজি ও ফল আবাদেও সেচের দরকার হয়। শ্যালোর বাইরে ওসব সেচে ব্যবহার হচ্ছে প্রায় ৩৭ হাজার ১৭৫টি গভীর নলকূপ ও ১ লাখ ৭৬ হাজার ৪৭৮টি লো লিফট পাম্প। সব মিলিয়ে ১৬ লাখ ১২ হাজার ৬১৩টি সেচ যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। তার মধ্যে বিদ্যুতে চলে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬৪টি। সেচের জন্য প্রতিদিন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান জানান, সেচের পানির সর্বোচ্চ ব্যবহারে কৃষি মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সেজন্য কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানোর পাশাপাশি পানির স্তরে ভারসাম্য আনতে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হচ্ছে। যেখানে বারিড পাইপ টেকসই ও সাশ্রয়ী হবে, সেখানে দ্রুততার সঙ্গে তা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে খাল খনন বা পুনঃখনন, বেড়িবাঁধ, রাবার ড্যাম নির্মাণ করে সেচের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। কার্যকর ও সঠিক সেচ যন্ত্রের ব্যবহারের কারণে দেশে পানির দক্ষ ব্যবহারের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে তা আরো বাড়বে।