দেশে ধান উৎপাদনে প্রতিবছরই কৃষকের পানির ব্যয় বাড়ছে
তারিথ
: ২৭-০১-২০১৯
অনলাইন ডেস্ক :
ধান উৎপাদনে কৃষকের প্রতি বছরই পানির ব্যয় বাড়ছে। বিশেষ করে হাইব্রিড ধানের ব্যবহার বাড়ায় পানির প্রয়োজন বাড়ছে। মূলত কৃষকর ভালো ফলনের আশায় অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করে। বর্তমানে সারাদেশে চলছে বোরো ধান রোপণ। বোরো মৌসুমে এক কেজি ধান উৎপাদনে সাড়ে ৩ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। আর ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে ওই পানির জোগান আসে। সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ওপর পাম্পের মাধ্যমে সেচের পানি তুলতে গিয়ে চাপ বাড়ছে। এক মৌসুমেই বোরো উৎপাদনে ব্যয় হচ্ছে হাজার কোটি টাকার জ্বালানি। তাতে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। দেশের কৃষক সেচের পেছনে মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৬২ শতাংশ অর্থ খরচ করে থাকে। ওই খরচ বিশ্বে সর্বোচ্চ। কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এক কেজি ধান উৎপাদনে বিগত ১৯৮০-৮১ সালে সেচের পানির প্রয়োজন হতো ২ হাজার ৮০০ লিটার। ২০০৬-০৭ সালে তা বেড়ে ৩ হাজার ২০০ লিটারে গিয়ে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালে তা সাড়ে ৩ হাজার লিটারে উঠেছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাবে বর্তমানে দেশে কৃষিকাজে ব্যবহার করা পাম্প আছে ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৩০টি। তার মধ্যে ডিজেলচালিত ১১ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি। আর বিদ্যুতে চলে মাত্র ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদ্যুতে চলে ১ লাখ ৫০ হাজার। ডিজেলে চলে ১০ লাখ ৭০ হাজার। ডিজেলে এবং ২৬ হাজার বিদ্যুতে চলে গভীর নলকূপের মধ্যে ১২ হাজার। বোরো মৌসুমে ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল কার্যকর থাকে। আগে ওসব টিউবওয়েলে ২০ থেকে ২২ ফুট মাটির নিচ থেকে পানি তোলা যেত। কিন্তু এখন মাটির ২৮ ফুট নিচে গিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কৃষক ৫ ফুট মাটি গর্ত করে সেখানে শ্যালো টিউবওয়েল বসাচ্ছে। তার পরও অনেক জায়গায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। সূত্র জানায়, প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানি ৩ থেকে ৮ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। আর ভূগর্ভের পানির অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে সেচের পাশাপাশি সুপেয় পানির পরিমাণও কমতে শুরু করেছে। পানির স্তর যতো নিচে নামবে, বোরোর উৎপাদন খরচ ততোই বাড়বে। বিগত ১৯৭০-৭১ সালে প্রকৃতিনির্ভর আমন ও আউশ থেকে মোট উৎপাদনের সিংহভাগ আসতো। বোরো থেকে আসতো মাত্র ২০ শতাংশ ফসল। কিন্তু এখন বোরো থেকে দেশের ৬০ শতাংশ চাল আসে। আর আমন থেকে ৩০ শতাংশ এবং আউশ থেকে ১০ শতাংশ আসে আউশ। এ সময়ে বোরোর মোট উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮ গুণ। একই সময়ে দেশে বর্ষার পানিনির্ভর আউশের চাষ এক-তৃতীয়াংশ জমিতে কমেছে। আর আমনের চাষ কমেছে ৪৪ শতাংশ। সূত্র আরো জানায়, সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণার বরাত দিয়ে দেশের সেচ ব্যবস্থার এই চিত্র তুলে ধরা হয়। নতুন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের জন্য মন্ত্রণালয়ের সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক দেশ ভূগর্ভস্থ পানি কৃষিকাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার সীমিত করেছে। সূত্র আরো জানায়, পানির সঙ্কট এড়াতে দেশে আউশ ও আমন ধানের উৎপাদনে জোর দিতে হবে। কারণ ওই দুটি ফসলের উৎপাদন খরচ কম। বৃষ্টির পানিতে আবাদ করা যায়। অথচ বোরো ধান আবাদে নিয়মিত সেচ দিতে গিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটে পড়ছে দেশ। তাছাড়া বোরো উৎপাদনে রাসায়সিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় জীববৈচিত্র্যসহ নষ্ট হচ্ছে পানি, পরিবেশ ও মাটির উর্বরা শক্তি। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। সেজন্য নদী-নালা খনন ও বড় বড় জলাশয় তৈরি করতে হবে। একই সাথে বাড়াতে হবে সেচ দক্ষতা। এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান জানান, যত্রতত্র পানি ব্যবহারের ফলে কৃষকের সেচ খরচ বাড়ছে। পানি কম লাগে- এমন জাতের উদ্ভাবন করতে হবে। পাশাপাশি ভূ-উপরিস্তরের পানির ব্যবহার না বাড়লে এবং বৃষ্টির পানি ধরে না রাখতে পারলে আগামীতে ভয়াবহ সেচ সংকটের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে কৃষিবিদ ড. আতাউর রহমান দেশে আউশ ও আমনের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জানান, বোরোতে সরকার সার, বীজ, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণের দিকে বিশেষ নজর দিলেও আমন আর আউশে তেমন নজর দিচ্ছে না। আমন ও আউশের উৎপাদন বাড়াতে হলে দেশি প্রজাতির ধানের পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষের আওতা বাড়াতে হবে। বন্যা এলাকার জন্য বন্যা সহিষ্ণু জাতের ধানের আবাদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।